শুক্রবার রাতে হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে গেলেন মাওলানা ইমদাদ হোসেন। ইমদাদ হোসেন ছুটিপুর জামে মসজিদের খতিব। বাড়ি ছুটিপুরেই। বড়ই বুজুুর্গ মানুষ তিনি। বয়স মধ্য চল্লিশ। অথচ চুল দাড়ি কোনোটাতেই পাক ধরেনি। হঠাৎ দেখলে মনে হয় বয়স পয়ত্রিশের ওপরে না। সুঠাম শরীর। ফর্সা গায়ের রং। জুমার দিন মিম্বরে বসে যখন খুতবা দেন দেখতে বড় ভালো লাগে। ইমদাদ হোসেনের বাবা- মা মাদরাসা লাইনের লোক নন। তবে ধার্মিক মানুষ । বড় আশা ছিলো ছেলেকে হাফেজ, মাওলান বানাবেন। দুনিয়ায় নেক সন্তান রেখে যাওয়া নাকি সদকায়ে জারিয়াহ। কবরে বসে বসে ছওয়াব পাওয়া যায়। এই ভাবনা থেকেই বাবা-মা ইমদাদ হোসেনকে মাদরাসায় দেন। ইমদাদ হোসেন বাবা-মাকে হতাশ করেননি। যশোর দড়াটানা মাদরাসা থেকে তিনি হাফেজ হয়েছেন। দাওরায়ে হাদিস শেষ করেছেন। উস্তাদগণের পরামর্শে সেখান থেকে দেওবন্দ গেছেন। ইমদাদ হোসেনের মেধা খুবই ভালো। তিনি যেখানেই পড়তে গেছেন উস্তাদদের দৃষ্টি কেড়েছেন। দেওবন্দে হাজার হাজার ছাত্রের মাঝে বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন। দেওবন্দে পড়া অবস্থাই বাবার ইন্তেকালের খবর পান। বাবার জানাযায় শরিক হওয়ার খুব ইচ্ছে ছিলো। হতে পারেননি। পাসপোর্ট ভিসার জটিলতায় বাড়িতে আসতে পারেননি। তবে দেওবন্দ থেকেই বাবার জন্য কান্নাকাটি করেছেন। বাবার পরকালীন মুক্তির জন্য হাত তুলে দোআ করেছেন। বাবা বেঁচে থাকতে বাবার শূন্যতা কখনও বুঝতে পারেননি। বাবা মারা যাওয়ার পর গভীর শূন্যতা বোঝতে পারলেন। পৃথিবীটা তার কাছে ধূসর মনে হতে লাগলো।
ফারেগ হওয়ার পর দেওবন্দেই খেদমত হওয়ার সুযোগ হয়েছিলো ইমদাদ হোসেনের। তিনি সেই সুযোগ গ্রহণ করেননি। এর পেছনে অবশ্য উল্লেখ করবার মতো কারণ আছে। নাহবেমির পড়া অবস্থায় নিজ গ্রাম নিয়ে অন্য রকম স্বপ্ন দেখা শুরু করেন তিনি। আলেমরা সব ঢাকা মুখি হয়ে যাচ্ছে। সেখানে হাজার হাজার মসজিদ মাদরাসা। দ্বীনের প্রচার প্রসার খুব ভালো ভাবে চলছে। অথচ গ্রামগুলো সব কিছু থেকে বঞ্চিত। চার-পাঁচটা গ্রাম খুঁজে একজন ভালো আলেম পাওয়া যায় না। মসজিদের ইমামতির জন্য যোগ্য মানুষ নেই। শিরিক বেদআতে ভেসে যাচ্ছে গ্রামের সাধারণ মানুষ। অন্য অঞ্চলের খবর জানা না থাকলেও ইমদাদ হেসেনের এলাকার চিত্র এমনই। ছোটবেলা থেকেই তিনি নিজ এলাকায় বড় সড় একটা মাদরাসা গড়ার স্বপ্ন দেখতেন। গ্রাম অঞ্চলের ছেলেরা সেখানে পড়বে। পড়াশোনা শেষে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বে। তাদের কল্যাণে গ্রামের শিক্ষাবঞ্চিত মানুষ দ্বীনের ওপর চলবে। ইমদাদ হোসেনের স্বপ্ন অনেকটাই পূরণ হয়েছে। ছুটিপুরে নিজস্ব জমিতে কওমি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। ধাপে ধাপে মিশকাত জামাত পযর্ন্ত খোলা হয়েছে। সামনের রমজানে দাওরায়ে হাদিস খোলার ইচ্ছা। ইমদাদ হোসেন এই মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মোহতামিম। মাদরাসার সাথেই দৃষ্টিনন্দন মসজিদ। মসজিদের খতিব তিনিই।
অতি অল্প সময়ে ইমদাদ হোসেন সাধারণ মানুষের সাথে মিশে গেছেন। গ্রামের লোকজন তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে। মাদরাসা মসজিদের জন্য সবাই নিবেদিত প্রাণ।
ইমদাদ হোসেনের এক ছেলে এক মেয়ে। আব্দুল্লাহ ও আমাতুল্লাহ। আব্দুল্লাহ বড়। এবার সে মিজান জামাতে পড়ছে। আমাতুল্লার বয়স চার। সে এখনও পড়ালেখা শুরু করেনি। ইমদাদ হোসেন এক উস্তাদের আলেমা মেয়ে বিয়ে করেছেন। স্ত্রীর নাম মরিয়ম। মরিয়ম সন্তানদের মানুষ করার ব্যাপারে পূর্ণ সচেতন। স্বামীর প্রতিও তিনি সমান যতœশীল। মোটকথা পারিবারিক জীবনে ইমদাদ হোসেন পূর্ণ সুখি একজন মানুষ।
হঠাৎ একটা সংবাদ এই সুখি মানুষটিকে পুরোপুরি এলোমেলো করে দিলো। সংবাদটা তিনি পেপারে পড়েছেন। ছুটিপুর গ্রাম হলেও নিয়মিত পেপার আসে। মাদরাসায় পেপার রাখার ব্যবস্থা আছে। ছাত্ররা বিকেলে পেপার দেখার সুযোগ পায়।
সেদিন দুপুরের পেপার খুলেই মন খারাপ করা সংবাদটা দেখলেন ইমদাদ হোসেন। ব্লগে আল্লাহ, রাসুল এবং ইসলাম ধর্ম নিয়ে খারাপ খারাপ কথা লেখা হয়েছে। ঘটনা বাংলাদেশে। এতোকাল আল্লাহ রাসুলের গালাগালির ঘটনা অমুসলিম দেশে ঘটেছে। এবার ঘটলো বাংলাদেশে। এমন খারাপ খারাপ কথা যা মুখে উ”্চারণ করা যায় না। ইমদাদ হোসেনের মন খুব খারাপ হয়ে গেলো। এসব কিসের আলামত। তিনি তাড়াতাড়ি ওজু করে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন। বিপদ মসিবতে নামাজ পড়া নবীজি সা. এর সুন্নাত। এই ঘটনার চেয়ে বড় মসিবত আর কী আছে?
নামাজ পড়েও মন শান্ত হলো না। বারবার তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। রাসুলের জন্য মন কাঁদছে। যে নবী সারাটা জীবন মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেলেন তাকে নিয়ে এমন অসভ্য কথা। ইমদাদ হোসেন বাড়িতে এলেন। তার বিধ্বস্ত চেহারা দেখে মরিয়ম ভয় পেয়ে গেলেন। স্বামীর এমন রূপ তিনি আর কোনো দিন দেখেননি। তিনি ভয় পাওয়া গলায় বললেন, কি হয়েছে? শরীর খারাপ হয়েছে নাকি?
ইমদাদ হোসেন ক্লান্ত গলায় বললেন, এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি দাও তো মরিয়ম।
মরিয়ম তাড়াতাড়ি কাঁচের গ্লাসে পানি এনে দিলেন। ইমদাদ হোসেন পানি খেয়ে শুয়ে পড়লেন। মরিয়ম মাথা টিপে দিতে দিতে বললেন, শরীর কি খুব খারাপ লাগছে?
ইমদাদ হোসেন পেপারের ঘটনা স্ত্রীকে জানালেন। তার অস্থিরতা মরিয়মের মধ্যে ঢুকে পড়লো। মরিয়ম চোখ বড় বড় করে বললেন, কি সর্বনাশ। আল্লাহর গজব আসবে তো!
বিকেলের দিকে কিছুটা সুস্থতাবোধ করতে লাগলেন ইমদাদ হোসেন। আসরের নামাজ পড়ে শিক্ষকদের সাথে অফিস রুমে বসলেন। শিক্ষকগণ আগে থেকেই ঘটনা জানতেন। যারা নতুন করে বিকেলে শুনলেন তারা খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এর প্রতিবাদ জানানো দরকার। সাহাবাগণ নবীজি সা. এর জন্য কতো কিছু করেছেন। চৌদ্দশ বছর পর এই দুর্বল উম্মতের জন্য অতটা সম্ভব না। তবে হাত পা গুটিয়েও বসে থাকা যায় না। এতো কিছুর পর চুপচাপ বসে থাকলে উম্মত বলে পরিচয় দেওয়াটাই লজ্জাজনক।
ইমদাদ হোসেন সিদ্ধান্ত নিলেন আগামী জুমার খুতবায় এর তীব্র নিন্দা জানাবেন। এসব চক্রান্তের ব্যাপারে জনগণকে সতর্ক করবেন। বাদ জুমআ বিক্ষোভ মিছিল বের হবে।
সাধারণ মানুষ এসবের কোনো খোঁজই রাখতো না। গ্রামের খেটে খাওয়া সাদাসিধে মানুষ। পেপার পত্রিকা পড়ে না। আবার এসব খবর সব পত্রিকায় আসেও না। তারা ক্ষেত খামার নিয়ে ব্যস্ত। শুক্রবারে খতিব সাহেবের আলোচনা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলো। এমন জঘন্য কাজ এদেশের কতিপয় তরুণের দ্বারা হতে পারে- তারা ভাবতে পারেনি। রাসুলের ভালোবাসায় তারা উত্তেজিত হয়ে পড়লো। মসজিদের ভিতরে কেউ কেউ দাঁড়িয়ে স্লোগান দিয়ে উঠলো। নামাজ শেষে মিছিল বের হলো। গ্রামের প্রধান প্রধান রাস্তা ঘুরে মিছিলটি শেষ হলো মসজিদ চত্বরে এসে। মিছিল শেষে ইসলাম বিদ্বেষীদের হেদায়েতের জন্য দোআ করা হলো।
ইমদাদ হোসেনের নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়ার অভ্যাস। তবে তাহাজ্জুদ তিনি ঘরে পড়েন না। মসজিদে গিয়ে পড়েন। বাড়ির পাশেই মসজিদ। একবারে ফজরের নামাজ পড়ে ঘরে ফেরেন। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নাস্তা করে মাদরাসায় যান। ন’টা থেকে ক্লাস। শুক্রবার দিবাগত রাতে তাহাজ্জুদের জন্য বেরিয়ে আর ফিরলেন না ইমদাদ হোসেন। ব্যাপারটা প্রথমে কেউ খেয়াল করেনি। মরিয়ম ভাবলেন হয়তো মাদরাসার কাজে আছে। মাদরাসা থেকে মনে করলো বাড়িতে আছেন। এসময়তো রোজ রোজ বাড়িতেই থাকেন। ন’টার দিকে মরিয়ম আব্দুল্লাহকে মাদরাসায় পাঠালেন বাবাকে ডেকে আনতে। একটু পরেই ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। বাড়িতে এসে যেন নাস্তা করে যান। আব্দুল্লাহ মাদরাসায় গিয়ে দেখলো বাবার রুম তালা দেওয়া। সে নায়েবে মোহতামিমের কাছে বাবার কথা জিজ্ঞাসা করলো। নায়েবে মোহতামিম সাহেব বললেন, হুজুর তো মাদরাসায় আসেননি। কেন বাড়িতে নেই?
আব্দুল্লাহ বললো না। মা আমাকে ডাকতে পাঠালেন। এবার সবার খেয়াল হলো ইমদাদ হোসেনকে ফজরের জামাতে দেখা যায়নি। তৎক্ষণাত তার মোবাইলে ফোন দেওয়া হলো। নাম্বার বন্ধ। মরিয়ম চিন্তিত হয়ে পড়লেন। সহকর্মীরা চারদিকে খোঁজ লাগালো। কোথাও পাওয়া গেলো না । দুপুর নাগাদ গ্রামময় চাউর হয়ে গেলো ইমদাদ হোসেন নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা। এলাকাবাসী ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। তাদের প্রিয় খতিব সাহেবের এই আকস্মিক অন্তর্ধান কেউ মেনে নিতে পারলো না। থানায় জিডি করা হলো। কিন্তু থানা ওয়ালারা তেমন গা করলো না। উল্টো বলে দিলো- ‘বুজুর্গ মানুষ। কোথাও হয়তো গেছেন। সময় হলে ফিরে আসবেন।’
তিনদিন পরের ঘটনা। ইমদাদ হোসেনের নিখোঁজ হওয়ার রেশ একটুও কমেনি। বরং বেড়েছে। পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। মানুষের মধ্যে গুঞ্জন কানাঘুষা চলছেই। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। কর্মব্যস্ত মানুষের কাজ-কর্ম বন্ধ নেই। এক সকালে মাহির আলি ঝালের ভুঁই নিরাচ্ছিল। বৃষ্টির সময় চলছে। বৃষ্টির পানি পেয়ে আগাছা ধাই ধাই করে বড় হয়। নিয়মিত পরিস্কার না করলে আগাছা ক্ষেতের পুষ্টি খেয়ে ফেলে। ভুঁই নিড়াতে নিড়াতে হঠাৎ একটা গন্ধ মাহির আলির নাকে এসে লাগলো। দখিণা বাতাসের সাথে ভেসে আসছে মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ। অনেকটা বেলীফুলের মতো। প্রথমে গুরুত্ব দিল না মাহির আলি। পাশেই গোরস্থান। গোরস্থান নানা রকম ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ। অনেক রকম জংলি ফুল ফোটে। হয়তো কোনো জংলি ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। মাহির আলি একমনে নিড়ানি চালাতে লাগলো। কিন্তু এই মনযোগ বেশিক্ষণ থাকলো না। গন্ধটা ধীরে ধীরে তীব্র হচ্ছে। মাহির আলির বুকে ধাক্কার মতো লাগলো। এমন গন্ধ সে আগে কখনও পায়নি। অনেকটা বেলীফুলের মতো। কিন্তু বেলীফুলের গন্ধ এতো তীব্র হয়ে বাতাসে ভাসে না। সে নিড়ানি রেখে চারপাশে তাকালো। গন্ধটার উৎস অনুমান করার চেষ্টা করলো। গন্ধটা গোরস্থানের দিক থেকে আসছে। সে গোরস্থানের দিকে এগোতে লাগলো। সে যতই এগোচ্ছে গন্ধটা বাড়ছে। পতঙ্গ যেমন আগুনের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে সেও গন্ধটার প্রতি তেমন আকর্ষণ বোধ করতে লাগলো। অলৌকিক কিছু একটা তাকে প্রবল ভাবে টানছে। গোরস্থানের মাঝে গিয়ে ঝোপের আড়ালে সে আলগা মাটি দেখতে পেলো। মাটি থেকেই গন্ধটা আসছে। সে একমুঠো মাটি তুলে নাকে ধরলো। এক অপার্থিব মিষ্টি গন্ধে তার সমস্ত চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। সে একই সাথে বিস্মিত হলো। এবং ভয় পেলো। ক্ষেতে আরও লোকজন ছিলো। সে চিৎকার করে সবাইকে ডাকলো। তার চিৎকারে এমন আতঙ্ক ছিলো যে লোকজন ছুটে না এসে পারলো না। তারাও বেলীফুলের মিষ্টি গন্ধে অভিভূত হয়ে পড়লো। কাশেমের হাতে কোদাল ছিলো। সে এর রহস্য উন্মেচনে মাটিতে কোপ বসালো। যতোই মাটি সরাতে লাগলো গন্ধটা ততোই তীব্র হতে লাগলো। হাত পাঁচেক খোড়ার পর সাদা কাপড় আর তাজা রক্ত দেখা গেলো। এসময় অন্যরাও তাড়াতাড়ি হাত লাগলো। মাটি সরানোর পর তারা অবাক হয়ে দেখলো তাদের প্রিয় হুজুরের রক্তাক্ত লাশ। সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন। তিনদিন পরেও তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। রক্ত থেকে অপার্থিব মিষ্টি গন্ধ আসছে। মাহির আলি তখনই গ্রামের দিকে ছুটলো। খবর পেয়ে হাজার হাজার মানুষের ঢল নামলো গোরস্থানে। এই করুণ দৃশ্য দেখে কেউ চোখের পানি আটকে রাখতে পারলো না। মরিয়ম বারবার জ্ঞান হারাতে লাগলেন। পাড়ার মহিলারা মরিয়মের মাথায় পানি ঢালতে লাগলো। আব্দুল্লাহ পুরোপুরি নির্বাক হয়ে গেলো। সে বুঝতে পারছে না বাবা নেই।
দুপুরের দিকে পুলিশ এলো। তারা ময়না তদন্তের জন্য লাশ নিয়ে যেতে চায়। গ্রামবাসী প্রতিরোধ করলো। তাদের প্রিয় খতিবের লাশ কাটা ছেঁড়া হতে দিবে না। পুলিশ ভয় পেয়ে গেলো। শুধু জনতার ভয় নয়। লাশের শরীর থেকে মিষ্টি গন্ধ আসছে। এই অলৌকিক ঘটনা তাদের ভয় ধরিয়ে দিলো। লাশ নিয়ে টানা হেচড়ার সাহস পেল না। কিছু আলামত সংগ্রহ করে তারা তদন্তে নেমে পড়লো। ইমদাদ হোসেনকে দাফন করা হলো পারিবারিক কবরস্থানে। গ্রামবাসী পরম ভক্তির সাথে কাফন দাফনে শরীক হলো।
পরিশিষ্ট:
এই ঘটনার পর অতি প্রগতিশীল হিসেবে ছুটিপুরের তিন যুবক হঠাৎ পাগল হয়ে গেলো। প্রতি পূর্ণিমা রাতে ইমদাদ হোসেনের কবর থেকে সেই অপার্থিব গন্ধটা প্রকাশ পায়। এসময় তিন পাগল ইমদাদ হোসেনের কবরের আশপাশে ঘুরঘুর করে। একটু খেয়াল করলেই দেখা যায় তারা পরম তৃপ্তিতে ইমদাদ হোসেনের কবরের মাটি তুলে তুলে খাচ্ছে।
ফারেগ হওয়ার পর দেওবন্দেই খেদমত হওয়ার সুযোগ হয়েছিলো ইমদাদ হোসেনের। তিনি সেই সুযোগ গ্রহণ করেননি। এর পেছনে অবশ্য উল্লেখ করবার মতো কারণ আছে। নাহবেমির পড়া অবস্থায় নিজ গ্রাম নিয়ে অন্য রকম স্বপ্ন দেখা শুরু করেন তিনি। আলেমরা সব ঢাকা মুখি হয়ে যাচ্ছে। সেখানে হাজার হাজার মসজিদ মাদরাসা। দ্বীনের প্রচার প্রসার খুব ভালো ভাবে চলছে। অথচ গ্রামগুলো সব কিছু থেকে বঞ্চিত। চার-পাঁচটা গ্রাম খুঁজে একজন ভালো আলেম পাওয়া যায় না। মসজিদের ইমামতির জন্য যোগ্য মানুষ নেই। শিরিক বেদআতে ভেসে যাচ্ছে গ্রামের সাধারণ মানুষ। অন্য অঞ্চলের খবর জানা না থাকলেও ইমদাদ হেসেনের এলাকার চিত্র এমনই। ছোটবেলা থেকেই তিনি নিজ এলাকায় বড় সড় একটা মাদরাসা গড়ার স্বপ্ন দেখতেন। গ্রাম অঞ্চলের ছেলেরা সেখানে পড়বে। পড়াশোনা শেষে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়বে। তাদের কল্যাণে গ্রামের শিক্ষাবঞ্চিত মানুষ দ্বীনের ওপর চলবে। ইমদাদ হোসেনের স্বপ্ন অনেকটাই পূরণ হয়েছে। ছুটিপুরে নিজস্ব জমিতে কওমি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। ধাপে ধাপে মিশকাত জামাত পযর্ন্ত খোলা হয়েছে। সামনের রমজানে দাওরায়ে হাদিস খোলার ইচ্ছা। ইমদাদ হোসেন এই মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মোহতামিম। মাদরাসার সাথেই দৃষ্টিনন্দন মসজিদ। মসজিদের খতিব তিনিই।
অতি অল্প সময়ে ইমদাদ হোসেন সাধারণ মানুষের সাথে মিশে গেছেন। গ্রামের লোকজন তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে। মাদরাসা মসজিদের জন্য সবাই নিবেদিত প্রাণ।
ইমদাদ হোসেনের এক ছেলে এক মেয়ে। আব্দুল্লাহ ও আমাতুল্লাহ। আব্দুল্লাহ বড়। এবার সে মিজান জামাতে পড়ছে। আমাতুল্লার বয়স চার। সে এখনও পড়ালেখা শুরু করেনি। ইমদাদ হোসেন এক উস্তাদের আলেমা মেয়ে বিয়ে করেছেন। স্ত্রীর নাম মরিয়ম। মরিয়ম সন্তানদের মানুষ করার ব্যাপারে পূর্ণ সচেতন। স্বামীর প্রতিও তিনি সমান যতœশীল। মোটকথা পারিবারিক জীবনে ইমদাদ হোসেন পূর্ণ সুখি একজন মানুষ।
হঠাৎ একটা সংবাদ এই সুখি মানুষটিকে পুরোপুরি এলোমেলো করে দিলো। সংবাদটা তিনি পেপারে পড়েছেন। ছুটিপুর গ্রাম হলেও নিয়মিত পেপার আসে। মাদরাসায় পেপার রাখার ব্যবস্থা আছে। ছাত্ররা বিকেলে পেপার দেখার সুযোগ পায়।
সেদিন দুপুরের পেপার খুলেই মন খারাপ করা সংবাদটা দেখলেন ইমদাদ হোসেন। ব্লগে আল্লাহ, রাসুল এবং ইসলাম ধর্ম নিয়ে খারাপ খারাপ কথা লেখা হয়েছে। ঘটনা বাংলাদেশে। এতোকাল আল্লাহ রাসুলের গালাগালির ঘটনা অমুসলিম দেশে ঘটেছে। এবার ঘটলো বাংলাদেশে। এমন খারাপ খারাপ কথা যা মুখে উ”্চারণ করা যায় না। ইমদাদ হোসেনের মন খুব খারাপ হয়ে গেলো। এসব কিসের আলামত। তিনি তাড়াতাড়ি ওজু করে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন। বিপদ মসিবতে নামাজ পড়া নবীজি সা. এর সুন্নাত। এই ঘটনার চেয়ে বড় মসিবত আর কী আছে?
নামাজ পড়েও মন শান্ত হলো না। বারবার তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। রাসুলের জন্য মন কাঁদছে। যে নবী সারাটা জীবন মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেলেন তাকে নিয়ে এমন অসভ্য কথা। ইমদাদ হোসেন বাড়িতে এলেন। তার বিধ্বস্ত চেহারা দেখে মরিয়ম ভয় পেয়ে গেলেন। স্বামীর এমন রূপ তিনি আর কোনো দিন দেখেননি। তিনি ভয় পাওয়া গলায় বললেন, কি হয়েছে? শরীর খারাপ হয়েছে নাকি?
ইমদাদ হোসেন ক্লান্ত গলায় বললেন, এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি দাও তো মরিয়ম।
মরিয়ম তাড়াতাড়ি কাঁচের গ্লাসে পানি এনে দিলেন। ইমদাদ হোসেন পানি খেয়ে শুয়ে পড়লেন। মরিয়ম মাথা টিপে দিতে দিতে বললেন, শরীর কি খুব খারাপ লাগছে?
ইমদাদ হোসেন পেপারের ঘটনা স্ত্রীকে জানালেন। তার অস্থিরতা মরিয়মের মধ্যে ঢুকে পড়লো। মরিয়ম চোখ বড় বড় করে বললেন, কি সর্বনাশ। আল্লাহর গজব আসবে তো!
বিকেলের দিকে কিছুটা সুস্থতাবোধ করতে লাগলেন ইমদাদ হোসেন। আসরের নামাজ পড়ে শিক্ষকদের সাথে অফিস রুমে বসলেন। শিক্ষকগণ আগে থেকেই ঘটনা জানতেন। যারা নতুন করে বিকেলে শুনলেন তারা খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এর প্রতিবাদ জানানো দরকার। সাহাবাগণ নবীজি সা. এর জন্য কতো কিছু করেছেন। চৌদ্দশ বছর পর এই দুর্বল উম্মতের জন্য অতটা সম্ভব না। তবে হাত পা গুটিয়েও বসে থাকা যায় না। এতো কিছুর পর চুপচাপ বসে থাকলে উম্মত বলে পরিচয় দেওয়াটাই লজ্জাজনক।
ইমদাদ হোসেন সিদ্ধান্ত নিলেন আগামী জুমার খুতবায় এর তীব্র নিন্দা জানাবেন। এসব চক্রান্তের ব্যাপারে জনগণকে সতর্ক করবেন। বাদ জুমআ বিক্ষোভ মিছিল বের হবে।
সাধারণ মানুষ এসবের কোনো খোঁজই রাখতো না। গ্রামের খেটে খাওয়া সাদাসিধে মানুষ। পেপার পত্রিকা পড়ে না। আবার এসব খবর সব পত্রিকায় আসেও না। তারা ক্ষেত খামার নিয়ে ব্যস্ত। শুক্রবারে খতিব সাহেবের আলোচনা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলো। এমন জঘন্য কাজ এদেশের কতিপয় তরুণের দ্বারা হতে পারে- তারা ভাবতে পারেনি। রাসুলের ভালোবাসায় তারা উত্তেজিত হয়ে পড়লো। মসজিদের ভিতরে কেউ কেউ দাঁড়িয়ে স্লোগান দিয়ে উঠলো। নামাজ শেষে মিছিল বের হলো। গ্রামের প্রধান প্রধান রাস্তা ঘুরে মিছিলটি শেষ হলো মসজিদ চত্বরে এসে। মিছিল শেষে ইসলাম বিদ্বেষীদের হেদায়েতের জন্য দোআ করা হলো।
ইমদাদ হোসেনের নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়ার অভ্যাস। তবে তাহাজ্জুদ তিনি ঘরে পড়েন না। মসজিদে গিয়ে পড়েন। বাড়ির পাশেই মসজিদ। একবারে ফজরের নামাজ পড়ে ঘরে ফেরেন। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নাস্তা করে মাদরাসায় যান। ন’টা থেকে ক্লাস। শুক্রবার দিবাগত রাতে তাহাজ্জুদের জন্য বেরিয়ে আর ফিরলেন না ইমদাদ হোসেন। ব্যাপারটা প্রথমে কেউ খেয়াল করেনি। মরিয়ম ভাবলেন হয়তো মাদরাসার কাজে আছে। মাদরাসা থেকে মনে করলো বাড়িতে আছেন। এসময়তো রোজ রোজ বাড়িতেই থাকেন। ন’টার দিকে মরিয়ম আব্দুল্লাহকে মাদরাসায় পাঠালেন বাবাকে ডেকে আনতে। একটু পরেই ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। বাড়িতে এসে যেন নাস্তা করে যান। আব্দুল্লাহ মাদরাসায় গিয়ে দেখলো বাবার রুম তালা দেওয়া। সে নায়েবে মোহতামিমের কাছে বাবার কথা জিজ্ঞাসা করলো। নায়েবে মোহতামিম সাহেব বললেন, হুজুর তো মাদরাসায় আসেননি। কেন বাড়িতে নেই?
আব্দুল্লাহ বললো না। মা আমাকে ডাকতে পাঠালেন। এবার সবার খেয়াল হলো ইমদাদ হোসেনকে ফজরের জামাতে দেখা যায়নি। তৎক্ষণাত তার মোবাইলে ফোন দেওয়া হলো। নাম্বার বন্ধ। মরিয়ম চিন্তিত হয়ে পড়লেন। সহকর্মীরা চারদিকে খোঁজ লাগালো। কোথাও পাওয়া গেলো না । দুপুর নাগাদ গ্রামময় চাউর হয়ে গেলো ইমদাদ হোসেন নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা। এলাকাবাসী ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। তাদের প্রিয় খতিব সাহেবের এই আকস্মিক অন্তর্ধান কেউ মেনে নিতে পারলো না। থানায় জিডি করা হলো। কিন্তু থানা ওয়ালারা তেমন গা করলো না। উল্টো বলে দিলো- ‘বুজুর্গ মানুষ। কোথাও হয়তো গেছেন। সময় হলে ফিরে আসবেন।’
তিনদিন পরের ঘটনা। ইমদাদ হোসেনের নিখোঁজ হওয়ার রেশ একটুও কমেনি। বরং বেড়েছে। পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। মানুষের মধ্যে গুঞ্জন কানাঘুষা চলছেই। কিন্তু জীবন তো থেমে থাকে না। কর্মব্যস্ত মানুষের কাজ-কর্ম বন্ধ নেই। এক সকালে মাহির আলি ঝালের ভুঁই নিরাচ্ছিল। বৃষ্টির সময় চলছে। বৃষ্টির পানি পেয়ে আগাছা ধাই ধাই করে বড় হয়। নিয়মিত পরিস্কার না করলে আগাছা ক্ষেতের পুষ্টি খেয়ে ফেলে। ভুঁই নিড়াতে নিড়াতে হঠাৎ একটা গন্ধ মাহির আলির নাকে এসে লাগলো। দখিণা বাতাসের সাথে ভেসে আসছে মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ। অনেকটা বেলীফুলের মতো। প্রথমে গুরুত্ব দিল না মাহির আলি। পাশেই গোরস্থান। গোরস্থান নানা রকম ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ। অনেক রকম জংলি ফুল ফোটে। হয়তো কোনো জংলি ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। মাহির আলি একমনে নিড়ানি চালাতে লাগলো। কিন্তু এই মনযোগ বেশিক্ষণ থাকলো না। গন্ধটা ধীরে ধীরে তীব্র হচ্ছে। মাহির আলির বুকে ধাক্কার মতো লাগলো। এমন গন্ধ সে আগে কখনও পায়নি। অনেকটা বেলীফুলের মতো। কিন্তু বেলীফুলের গন্ধ এতো তীব্র হয়ে বাতাসে ভাসে না। সে নিড়ানি রেখে চারপাশে তাকালো। গন্ধটার উৎস অনুমান করার চেষ্টা করলো। গন্ধটা গোরস্থানের দিক থেকে আসছে। সে গোরস্থানের দিকে এগোতে লাগলো। সে যতই এগোচ্ছে গন্ধটা বাড়ছে। পতঙ্গ যেমন আগুনের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে সেও গন্ধটার প্রতি তেমন আকর্ষণ বোধ করতে লাগলো। অলৌকিক কিছু একটা তাকে প্রবল ভাবে টানছে। গোরস্থানের মাঝে গিয়ে ঝোপের আড়ালে সে আলগা মাটি দেখতে পেলো। মাটি থেকেই গন্ধটা আসছে। সে একমুঠো মাটি তুলে নাকে ধরলো। এক অপার্থিব মিষ্টি গন্ধে তার সমস্ত চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। সে একই সাথে বিস্মিত হলো। এবং ভয় পেলো। ক্ষেতে আরও লোকজন ছিলো। সে চিৎকার করে সবাইকে ডাকলো। তার চিৎকারে এমন আতঙ্ক ছিলো যে লোকজন ছুটে না এসে পারলো না। তারাও বেলীফুলের মিষ্টি গন্ধে অভিভূত হয়ে পড়লো। কাশেমের হাতে কোদাল ছিলো। সে এর রহস্য উন্মেচনে মাটিতে কোপ বসালো। যতোই মাটি সরাতে লাগলো গন্ধটা ততোই তীব্র হতে লাগলো। হাত পাঁচেক খোড়ার পর সাদা কাপড় আর তাজা রক্ত দেখা গেলো। এসময় অন্যরাও তাড়াতাড়ি হাত লাগলো। মাটি সরানোর পর তারা অবাক হয়ে দেখলো তাদের প্রিয় হুজুরের রক্তাক্ত লাশ। সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন। তিনদিন পরেও তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। রক্ত থেকে অপার্থিব মিষ্টি গন্ধ আসছে। মাহির আলি তখনই গ্রামের দিকে ছুটলো। খবর পেয়ে হাজার হাজার মানুষের ঢল নামলো গোরস্থানে। এই করুণ দৃশ্য দেখে কেউ চোখের পানি আটকে রাখতে পারলো না। মরিয়ম বারবার জ্ঞান হারাতে লাগলেন। পাড়ার মহিলারা মরিয়মের মাথায় পানি ঢালতে লাগলো। আব্দুল্লাহ পুরোপুরি নির্বাক হয়ে গেলো। সে বুঝতে পারছে না বাবা নেই।
দুপুরের দিকে পুলিশ এলো। তারা ময়না তদন্তের জন্য লাশ নিয়ে যেতে চায়। গ্রামবাসী প্রতিরোধ করলো। তাদের প্রিয় খতিবের লাশ কাটা ছেঁড়া হতে দিবে না। পুলিশ ভয় পেয়ে গেলো। শুধু জনতার ভয় নয়। লাশের শরীর থেকে মিষ্টি গন্ধ আসছে। এই অলৌকিক ঘটনা তাদের ভয় ধরিয়ে দিলো। লাশ নিয়ে টানা হেচড়ার সাহস পেল না। কিছু আলামত সংগ্রহ করে তারা তদন্তে নেমে পড়লো। ইমদাদ হোসেনকে দাফন করা হলো পারিবারিক কবরস্থানে। গ্রামবাসী পরম ভক্তির সাথে কাফন দাফনে শরীক হলো।
পরিশিষ্ট:
এই ঘটনার পর অতি প্রগতিশীল হিসেবে ছুটিপুরের তিন যুবক হঠাৎ পাগল হয়ে গেলো। প্রতি পূর্ণিমা রাতে ইমদাদ হোসেনের কবর থেকে সেই অপার্থিব গন্ধটা প্রকাশ পায়। এসময় তিন পাগল ইমদাদ হোসেনের কবরের আশপাশে ঘুরঘুর করে। একটু খেয়াল করলেই দেখা যায় তারা পরম তৃপ্তিতে ইমদাদ হোসেনের কবরের মাটি তুলে তুলে খাচ্ছে।
ঘরটা বেশ বড়। ফার্নিচার কম থাকায় যতটা না বড় তারচাইতেও বড় দেখায়। উল্লেখযোগ্য ফার্নিচার বলতে একটা বিরাট আকারের খাট, শো-কেস, রাইটিং টেবিল আর দুটো চেয়ার। আর আছে দুটো পেইন্টিং। পেইন্টিংকে বোধহয় আসবাবের শ্রেণিতে ফেলা যায় না। তবে এই রুমের আভিজাত্য অনেকাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে এই পেইন্টিং দুটো। একটা পেইন্টিং সূর্যোদয়ের। লাল টকটকে সূর্য মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে।
ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত নাকি কাকতালীয় বলা যাচ্ছে না। দ্বিতীয় পেইন্টিংটা সূর্যাস্তের। ছবি দেখে বোঝা সম্ভব না কোনটা সূর্যাস্তের আর কোনটা সূর্যোদয়ের। দুটোতেই মাটির কাছে নেমে আসা লাল সূর্য। তবে এই দুটো পেইন্টিং সম্ভবত একজন শিল্পীরই আঁকা। এবং তিনি দুটো পেইন্টিংকে পরস্পরের সম্পূরক হিসেবে এঁকেছেন। যার জন্য সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত আলাদা করার জন্য সূক্ষ্ম একটা পার্থক্য তিনি রচনা করেছেন।
একটা ছবিতে সূর্যের গায়ে কয়েকটা উড়ন্ত বিন্দু দেখা যাচ্ছে। সন্ধ্যায় নীড়ে ফেরা পাখি। এই বিন্দুগুলোই দুটো ছবির মধ্যে একটা অদৃশ্য রেখা টেনে দিচ্ছে। বুঝিয়ে দিচ্ছে কোনটা সূর্যোদয়ের আর কোনটা সূর্যাস্তের।
মেয়েটা একটা জিনিস নেবার জন্য এই রুমে এসেছিল। ঠিক তখনই হঠাৎ করে সূক্ষ্ম পার্থক্যটা ধরা পড়েছে তার চোখে। এতক্ষণ এটা নিয়েই ভাবছিল। এখন জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। বিশাল একটা জানালা আছে রুমের দক্ষিণ দিকে। জানালা দিয়ে বাতাস আসছে। বাতাসে মেয়েটার চুলগুলো উড়ছে অল্প অল্প। কয়েকটি চুল বারবার কপালে এসে বিরক্ত করছে। মেয়েটা চাইলেই চুলগুলোকে কানের পেছনে গুজে দিতে পারে, কিন্তু তেমন কোনো ইচ্ছা দেখা যাচ্ছে না তার মধ্যে। মেয়েটা জানালার দিকে তাকিয়ে ভাবছে, যে বাতাসটা ওর চুলগুলো নিয়ে খেলা করছে এটাকেই কি দখিণা হাওয়া বলে?
ভাবনাটা অদ্ভূত। অন্তত এই সময়টাতে এমন ভাবনা আসাটা একেবারেই উচিত না। তবুও আসছে। আজ মেয়েটার সব ভাবনাই উল্টো খাতে বইছে। এখন ওর উচিত খানিকটা মন খারাপ করা। কিন্তু সবসময় উচিত কাজটা করতে ইচ্ছে করে না। যেমন রোগি দেখতে গেলেই তার দুনিয়ার হাসির কথা মনে পড়ে যায়। বিচ্ছিরি ব্যাপার! না হাসা যায়, না মুখ গম্ভীর করে রাখা যায়।
একবার গ্রাম থেকে মেয়েটার দুঃসম্পর্কের এক আত্মীয় ঢাকার একটা হাসপাতালে ভর্তি হয়। তখন ও অনেক ছোট। ক্লাস সিক্স কিংবা সেভেনে পড়ে। বাবার সাথে হাসপাতালে গিয়েছিল সেই আত্মীয়কে দেখতে। ওর বাবাকে দেখেই হাউমাউ করে ওঠলো সেই আত্মীয়টা, 'মাইরালাও আমারে তুমরা মাইরালাও! লোকটার বলার ভঙ্গি এতটাই অদ্ভূত ছিল যে, মেয়েটা শত চেষ্টার পরও নাক মুখ দিয়ে অদম্য গতিতে বেরিয়ে আসা 'খুক' জাতীয় বিচিত্র আওয়াজটা আটকাতে পারল না। বাবা কটমট করে তাকালেন ওর দিকে। বাবার তাকানোর ভঙ্গি দেখে আরও হাসি পেয়ে গেল মেয়েটার। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে হাসিটা আটকাবার চেষ্টা শুরু করে দিলো। যদিও নিচের ঠোঁটটা ব্যাবহার করে কান্না আটকাবার জন্য। এরপরও সেদিন বেশ কাজে দিয়েছিল কৌশলটা।
বাবার মেজাজটা এমনিতে বেশ চড়া। পুলিশ কিনা! এসবি'র অফিসার। অফিসের সবাই ভয় পায়। অপরাধীদের নাকি একেবারে হিসু করিয়ে ছাড়েন!
কিন্তু সে তো আর অপরাধী না, তার সাথে কেন পুলিশি মেজাজ দেখাতে হবে? এটা কোরো না,ওটা কোরো না, তোমাকে নিয়ে আর পারি না, বেশি স্বাধীনতা দেওয়া হচ্ছে তোমাকে, এসব কথা ওকে প্রতিদিনই শুনতে হয়। ওর অভিমান হয়, রাগ হয়, গলার কাছে কী যেন দলা পাকিয়ে ওঠে।
মা তো আরেক কাটি সরেস। বাবা রাতে অফিস থেকে ফিরলেই রাজ্যের অভিযোগ দায়ের করবে। যেন বাবা ঘরেও পুলিশের দায়িত্ব নিয়ে এসেছে। আর কথাগুলোর কী ছিরি! তোমার মেয়ে তো দিনে দিনে উচ্ছনে যাচ্ছে, ওর জন্যই সংসারে যত অশান্তি, ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপর শুরু হয় দুজনের যৌথ উপদেশ বর্ষণ, মাঝে মধ্যে ধমকি।
এই তো সেদিন,ফিরতে একটু রাত হয়েছিল ওর, তাই বলে এইভাবে বকা দিতে হবে? ও কী এখনো ছোট আছে? একা একা চলতে ফিরতে পারে না? আর কী-ই বা এমন স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে ওকে। ওর বয়স এখন সতেরো। ইউরোপ- আমেরিকায় তো এই বয়সে মেয়েরা একা একা বিশ্ব ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে। এইতো কিছুদিন আগেও তো পত্রিকায় পড়ল, চৌদ্দবছর বয়সী এক অস্ট্রেলিয়ান কিশোরি নৌকা নিয়ে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছে। বাঙালি হয়েছে বলেই কি ওকে ঘোমটা পড়ে ঘরে বসে থাকতে হবে? সারাজীবন স্বামী নামক লোকটার পা টিপে কাটাতে হবে?
এই বয়সে বন্ধু-বান্ধবের সাথে আড্ডা না দিলে আর কবে দেবে? এই যে বাবা মা- মধ্যবয়স পার করে ফেলেছে। তারা জীবনের কাছ থেকে কী পেয়েছে? কিছুই না। অন্তত সে যতটুকু পেয়েছে তার একশভাগের এক ভাগও না। ওর কত বন্ধু! বিশেষ করে রনি তো ওর খুবই ভালো বন্ধু। কত হেল্প করে ওকে। হাতে যেদিন টাকা না থাকে সেদিন সব খরচ রনিই দেয়। সে অবশ্য অন্যায়ভাবে রনির ঋণ শোধ করে দেয়। আবার রনির কাছে টাকা না থাকলে তো ও-ই খরচ বহন করে। এটাই তো প্রকৃত বন্ধুত্বের পরিচায়ক। অথচ বাবা মা এগুলো বুঝতে চায় না। ওর অভিমান হয়, বড় অভিমান। তবে আজকের পর থেকে আর কখনোই ওকে অভিমানী হতে হবে না...।
মেয়েটা রুম থেকে বেরিয়ে এলো। এখানে এসেছিল ছুরিটা নিতে। বেশ বড় মাংস কাটার ছুরি। আলো পড়লেই ঝিলিক দিয়ে ওঠে। ছুরিটা নিয়ে পাশের রুমে চলে এলো। খাটের ওপর দুটো অচেতন দেহ পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে এলোমেলো ভঙ্গিতে। একজোড়া নারী পুরুষ। কিছুক্ষণ আগে কফির সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে এদের অচেতন করেছে মেয়েটা। তার দরকারও আছে, কারণ এখন সে যা করতে যাচ্ছে তাতে এছাড়া বিকল্প কিছু আর ছিল না। মেয়েটা বড় করে একটা দম নিল। চোখের সামনে এসে পড়া চুলগুলোকে কানের পেছনে গুঁজে দিয়েই ছুরিটা চালিয়ে দিল নারী দেহটা লক্ষ্য করে। একটু যেন কেঁপে ওঠলো সজ্ঞাহীন দেহটা। গোটা দেহে একের পর এক ছুরিকাঘাত করে যাচ্ছে সে, পাগলের মতো, উন্মাদিনীর মতো,অভিমানীর মতো।
প্রায় আট দশটা আঘাত করার পর হঠাৎ সংবিত ফিরে পায় মেয়েটা। ছুরির আঘাতে অচেতন নারী দেহে চেতনা ফিরে এসেছে। ভয়াবহ যন্ত্রণায় মোচড় খাচ্ছে দেহটা, গোঙাচ্ছে। মেয়েটার বুকও সামান্য সময়ের জন্য মোচড় দিয়ে ওঠলো। তবে মোচড় ফোচড়কে আমলে নিল না সে। দেরি না করে এবার ছুরিটা সে চালিয়ে দিল মোচড়াতে থাকা দেহটার গলায়। এতক্ষণে যা হয়নি, গলায় মাত্র দুটো আঘাত করতেই নিথর হয়ে গেল দেহটা। ফিনকি দিয়ে রক্তের ফোয়ারা ছুটলো। বোধহয় গলাটা দু টুকরো হয়ে গেছে। মেয়েটার চেহারায় রক্তের ছিটা লাগলো, মুখে পেলো নোনতা স্বাদ। সেই সঙ্গে সে আবিষ্কার করলো দেহের যেকোনো অঙ্গের চাইতে গলায় ছুরি চালানোটা অনেক বেশি কার্যকর। দ্বিতীয় দেহটার ক্ষেত্রে কার্যকর পদ্ধতিটাই এবার প্রয়োগ করলো সে। মাত্র দুবার গলায় পোচ দিতেই দেহটা একটা খিঁচুনি দিয়ে নিথর হয়ে গেল।
এরপর পরই কয়েকটা মিশ্র অনুভূতি এসে জায়গা নিল তার মনে। ভয়, বিস্ময়, আতঙ্ক, অভিমান। খাটের উপর রক্তের ধারাগুলো জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। সেদিকে তাকিয়ে একটুখানি কষ্টও অনুভব করলো।
তবে দুঃখ কষ্ট নিয়ে মাথা ঘামাবার মতো সময় এখন ওর নেই। সামনে অনেক কাজ পড়ে আছে। চাপ চাপ রক্ত জমে থাকা খাট থেকে ওঠে দাঁড়াল ঐশী নামের মেয়েটা, যে কিনা একটু আগেই তার বাবা-মা'কে খুন করেছে।
ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত নাকি কাকতালীয় বলা যাচ্ছে না। দ্বিতীয় পেইন্টিংটা সূর্যাস্তের। ছবি দেখে বোঝা সম্ভব না কোনটা সূর্যাস্তের আর কোনটা সূর্যোদয়ের। দুটোতেই মাটির কাছে নেমে আসা লাল সূর্য। তবে এই দুটো পেইন্টিং সম্ভবত একজন শিল্পীরই আঁকা। এবং তিনি দুটো পেইন্টিংকে পরস্পরের সম্পূরক হিসেবে এঁকেছেন। যার জন্য সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত আলাদা করার জন্য সূক্ষ্ম একটা পার্থক্য তিনি রচনা করেছেন।
একটা ছবিতে সূর্যের গায়ে কয়েকটা উড়ন্ত বিন্দু দেখা যাচ্ছে। সন্ধ্যায় নীড়ে ফেরা পাখি। এই বিন্দুগুলোই দুটো ছবির মধ্যে একটা অদৃশ্য রেখা টেনে দিচ্ছে। বুঝিয়ে দিচ্ছে কোনটা সূর্যোদয়ের আর কোনটা সূর্যাস্তের।
মেয়েটা একটা জিনিস নেবার জন্য এই রুমে এসেছিল। ঠিক তখনই হঠাৎ করে সূক্ষ্ম পার্থক্যটা ধরা পড়েছে তার চোখে। এতক্ষণ এটা নিয়েই ভাবছিল। এখন জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। বিশাল একটা জানালা আছে রুমের দক্ষিণ দিকে। জানালা দিয়ে বাতাস আসছে। বাতাসে মেয়েটার চুলগুলো উড়ছে অল্প অল্প। কয়েকটি চুল বারবার কপালে এসে বিরক্ত করছে। মেয়েটা চাইলেই চুলগুলোকে কানের পেছনে গুজে দিতে পারে, কিন্তু তেমন কোনো ইচ্ছা দেখা যাচ্ছে না তার মধ্যে। মেয়েটা জানালার দিকে তাকিয়ে ভাবছে, যে বাতাসটা ওর চুলগুলো নিয়ে খেলা করছে এটাকেই কি দখিণা হাওয়া বলে?
ভাবনাটা অদ্ভূত। অন্তত এই সময়টাতে এমন ভাবনা আসাটা একেবারেই উচিত না। তবুও আসছে। আজ মেয়েটার সব ভাবনাই উল্টো খাতে বইছে। এখন ওর উচিত খানিকটা মন খারাপ করা। কিন্তু সবসময় উচিত কাজটা করতে ইচ্ছে করে না। যেমন রোগি দেখতে গেলেই তার দুনিয়ার হাসির কথা মনে পড়ে যায়। বিচ্ছিরি ব্যাপার! না হাসা যায়, না মুখ গম্ভীর করে রাখা যায়।
একবার গ্রাম থেকে মেয়েটার দুঃসম্পর্কের এক আত্মীয় ঢাকার একটা হাসপাতালে ভর্তি হয়। তখন ও অনেক ছোট। ক্লাস সিক্স কিংবা সেভেনে পড়ে। বাবার সাথে হাসপাতালে গিয়েছিল সেই আত্মীয়কে দেখতে। ওর বাবাকে দেখেই হাউমাউ করে ওঠলো সেই আত্মীয়টা, 'মাইরালাও আমারে তুমরা মাইরালাও! লোকটার বলার ভঙ্গি এতটাই অদ্ভূত ছিল যে, মেয়েটা শত চেষ্টার পরও নাক মুখ দিয়ে অদম্য গতিতে বেরিয়ে আসা 'খুক' জাতীয় বিচিত্র আওয়াজটা আটকাতে পারল না। বাবা কটমট করে তাকালেন ওর দিকে। বাবার তাকানোর ভঙ্গি দেখে আরও হাসি পেয়ে গেল মেয়েটার। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে হাসিটা আটকাবার চেষ্টা শুরু করে দিলো। যদিও নিচের ঠোঁটটা ব্যাবহার করে কান্না আটকাবার জন্য। এরপরও সেদিন বেশ কাজে দিয়েছিল কৌশলটা।
বাবার মেজাজটা এমনিতে বেশ চড়া। পুলিশ কিনা! এসবি'র অফিসার। অফিসের সবাই ভয় পায়। অপরাধীদের নাকি একেবারে হিসু করিয়ে ছাড়েন!
কিন্তু সে তো আর অপরাধী না, তার সাথে কেন পুলিশি মেজাজ দেখাতে হবে? এটা কোরো না,ওটা কোরো না, তোমাকে নিয়ে আর পারি না, বেশি স্বাধীনতা দেওয়া হচ্ছে তোমাকে, এসব কথা ওকে প্রতিদিনই শুনতে হয়। ওর অভিমান হয়, রাগ হয়, গলার কাছে কী যেন দলা পাকিয়ে ওঠে।
মা তো আরেক কাটি সরেস। বাবা রাতে অফিস থেকে ফিরলেই রাজ্যের অভিযোগ দায়ের করবে। যেন বাবা ঘরেও পুলিশের দায়িত্ব নিয়ে এসেছে। আর কথাগুলোর কী ছিরি! তোমার মেয়ে তো দিনে দিনে উচ্ছনে যাচ্ছে, ওর জন্যই সংসারে যত অশান্তি, ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপর শুরু হয় দুজনের যৌথ উপদেশ বর্ষণ, মাঝে মধ্যে ধমকি।
এই তো সেদিন,ফিরতে একটু রাত হয়েছিল ওর, তাই বলে এইভাবে বকা দিতে হবে? ও কী এখনো ছোট আছে? একা একা চলতে ফিরতে পারে না? আর কী-ই বা এমন স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে ওকে। ওর বয়স এখন সতেরো। ইউরোপ- আমেরিকায় তো এই বয়সে মেয়েরা একা একা বিশ্ব ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে। এইতো কিছুদিন আগেও তো পত্রিকায় পড়ল, চৌদ্দবছর বয়সী এক অস্ট্রেলিয়ান কিশোরি নৌকা নিয়ে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছে। বাঙালি হয়েছে বলেই কি ওকে ঘোমটা পড়ে ঘরে বসে থাকতে হবে? সারাজীবন স্বামী নামক লোকটার পা টিপে কাটাতে হবে?
এই বয়সে বন্ধু-বান্ধবের সাথে আড্ডা না দিলে আর কবে দেবে? এই যে বাবা মা- মধ্যবয়স পার করে ফেলেছে। তারা জীবনের কাছ থেকে কী পেয়েছে? কিছুই না। অন্তত সে যতটুকু পেয়েছে তার একশভাগের এক ভাগও না। ওর কত বন্ধু! বিশেষ করে রনি তো ওর খুবই ভালো বন্ধু। কত হেল্প করে ওকে। হাতে যেদিন টাকা না থাকে সেদিন সব খরচ রনিই দেয়। সে অবশ্য অন্যায়ভাবে রনির ঋণ শোধ করে দেয়। আবার রনির কাছে টাকা না থাকলে তো ও-ই খরচ বহন করে। এটাই তো প্রকৃত বন্ধুত্বের পরিচায়ক। অথচ বাবা মা এগুলো বুঝতে চায় না। ওর অভিমান হয়, বড় অভিমান। তবে আজকের পর থেকে আর কখনোই ওকে অভিমানী হতে হবে না...।
মেয়েটা রুম থেকে বেরিয়ে এলো। এখানে এসেছিল ছুরিটা নিতে। বেশ বড় মাংস কাটার ছুরি। আলো পড়লেই ঝিলিক দিয়ে ওঠে। ছুরিটা নিয়ে পাশের রুমে চলে এলো। খাটের ওপর দুটো অচেতন দেহ পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে এলোমেলো ভঙ্গিতে। একজোড়া নারী পুরুষ। কিছুক্ষণ আগে কফির সাথে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে এদের অচেতন করেছে মেয়েটা। তার দরকারও আছে, কারণ এখন সে যা করতে যাচ্ছে তাতে এছাড়া বিকল্প কিছু আর ছিল না। মেয়েটা বড় করে একটা দম নিল। চোখের সামনে এসে পড়া চুলগুলোকে কানের পেছনে গুঁজে দিয়েই ছুরিটা চালিয়ে দিল নারী দেহটা লক্ষ্য করে। একটু যেন কেঁপে ওঠলো সজ্ঞাহীন দেহটা। গোটা দেহে একের পর এক ছুরিকাঘাত করে যাচ্ছে সে, পাগলের মতো, উন্মাদিনীর মতো,অভিমানীর মতো।
প্রায় আট দশটা আঘাত করার পর হঠাৎ সংবিত ফিরে পায় মেয়েটা। ছুরির আঘাতে অচেতন নারী দেহে চেতনা ফিরে এসেছে। ভয়াবহ যন্ত্রণায় মোচড় খাচ্ছে দেহটা, গোঙাচ্ছে। মেয়েটার বুকও সামান্য সময়ের জন্য মোচড় দিয়ে ওঠলো। তবে মোচড় ফোচড়কে আমলে নিল না সে। দেরি না করে এবার ছুরিটা সে চালিয়ে দিল মোচড়াতে থাকা দেহটার গলায়। এতক্ষণে যা হয়নি, গলায় মাত্র দুটো আঘাত করতেই নিথর হয়ে গেল দেহটা। ফিনকি দিয়ে রক্তের ফোয়ারা ছুটলো। বোধহয় গলাটা দু টুকরো হয়ে গেছে। মেয়েটার চেহারায় রক্তের ছিটা লাগলো, মুখে পেলো নোনতা স্বাদ। সেই সঙ্গে সে আবিষ্কার করলো দেহের যেকোনো অঙ্গের চাইতে গলায় ছুরি চালানোটা অনেক বেশি কার্যকর। দ্বিতীয় দেহটার ক্ষেত্রে কার্যকর পদ্ধতিটাই এবার প্রয়োগ করলো সে। মাত্র দুবার গলায় পোচ দিতেই দেহটা একটা খিঁচুনি দিয়ে নিথর হয়ে গেল।
এরপর পরই কয়েকটা মিশ্র অনুভূতি এসে জায়গা নিল তার মনে। ভয়, বিস্ময়, আতঙ্ক, অভিমান। খাটের উপর রক্তের ধারাগুলো জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। সেদিকে তাকিয়ে একটুখানি কষ্টও অনুভব করলো।
তবে দুঃখ কষ্ট নিয়ে মাথা ঘামাবার মতো সময় এখন ওর নেই। সামনে অনেক কাজ পড়ে আছে। চাপ চাপ রক্ত জমে থাকা খাট থেকে ওঠে দাঁড়াল ঐশী নামের মেয়েটা, যে কিনা একটু আগেই তার বাবা-মা'কে খুন করেছে।