রুদ্ধ ইজি এক্জিট, হেফাজতের উত্তাপ ওশিষ্টাচার বর্জনের মাইলফলক
মাওলানা মামুনুল হক
মাওলানা মামুনুল হক
উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ২৫ শে অক্টোবর যতোটা প্রাণহানি ও সংঘাতের আতঙ্ক ছড়িয়েছিল ততোটা হয়নি। চারিদিকের সব দু:সংবাদের মধ্যে এই একটু স্বস্তির সংবাদ দিয়ে শুরু করলাম- বর্তমান প্রসঙ্গ পর্যালোচনা। ২০০৬ ভয়াল ২৮ শে অক্টোব রের লগি-বৈঠা তাণ্ডব আর রাজপথে প্রকাশ্য দিবালোকে লাঠি দিয়ে সাপের মতো খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে মানুষ হত্যা ও মানুষের মরদেহের ওপর পৈশাচিক নৃত্যের বিভৎস নৃশংসতা দু:স্বপ্নের মতো এখনও তাড়া করে ফেরে বাংলাদেশের মানুষকে। ২৫ শে অক্টোরব’১৩ কে ঘিরেও তেমনই একটা আতঙ্ক বিরাজ করছিল মানুষের মনে। যদিও বাংলাদেশ এখন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার দেশ। অনিবার্য সংঘাতের দিকে ধাবমান একটি জনপদ। চারিদিকে আকণ্ঠ অন্ধকারে নিমজ্জিত এই দেশে আপাতত মুক্তির আলোর কোনো হাতছানি নেই। এরপরও ২৫ অক্টোবর বড় রকমের সহিংসতা না হওয়ায় বহু মানুষ স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলেছে। ২৫ অক্টোবরের ডেট লাইনে সহিংসতা না হলেও প্রাণহানী কিন্তু থেমে নেই। নেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার কোনো আলামত। বরং অবস্থা ধীরে ধীরে চূড়ান্ত একটি সংঘাতের দিকেই গড়াচ্ছে বলে মনে হয়।
২৫ অক্টোবর ১৮ দলীয় জোট সমাবেশ করার সিদ্ধান্তে অটল থাকায় অবশেষে সরকারকেই পিছু হটতে হয়েছে। দিতে হয়েছে সমাবেশের অনুমতি। এর আগে সব ধরণের সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল ঢাকার পুলিশ প্রশাসন। সূচনাতেই নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও পরে পিছিয়ে যাওয়ার এই ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো, বিরোধীজোটের আন্দোলনের সাফল্য নির্ভর করছে ময়দানে তাদের অনড় অবস্থানের ওপর। দুর্বলতা ও দোদুল্যমানতা নিয়ে কোনো অবস্থানে পৌঁছতে পারবে না বিরোধীজোট।
২৫ অক্টোবরের সমাবেশে ১৮ দলীয় জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার একটি দুর্বলতা লক্ষ করা গেছে। যা সাধারণত তার ক্ষেত্রে দেখা যায় না। ৬০ ঘণ্টার হরতাল ঘোষণার ক্ষেত্রে কোনো আল্টিমেটাম দেওয়ার পূর্বালোচনা বা সিদ্ধান্ত ছিল না। বরং আন্দোলন ও সংলাপ একই সঙ্গে চলার ঘোষণাই ছিল ১৮ দলের স্ট্রাটেজি। কিন্তু বেগম জিয়ার বক্তব্যে সরকারের পক্ষ থেকে দুই দিনের মধ্যে সংলাপ ও আলোচনার আয়োজন না করলে হরতালের ঝুলন্ত ঘোষণা চলে আসে। এটা ছিল তার মুখ ফস্কে বের হয়ে যাওয়া একটি ব্যাপার। যদিও সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তার আন্দোলন-সংলাপ একসঙ্গে চলার নীতি আন্দোলন ও সংলাপ একসঙ্গে চলার নীতি ও অবস্থানের কথা স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মিডিয়ার সিংহভাগই যেহেতু ধর্মনিরপেক্ষ ও আওয়ামী বলয়ের, তাই তারা এখানে ১৮ দল বা বেগম জিয়াকে কোনো ছাড় দেয়নি। বরং তার মুখ ফস্কা কথাকেই হাইলাইট করেছে। আর সেই সুযোগটাই লুফে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। নির্ধারিত দুই দিনের মধ্যেই ফোনালাপের মাধ্যমে বল বিরোধী দলের কোর্টে ঠেলে দিয়েছেন। এটা ছিল বিরোধীদলের জন্য একটা বিব্রতকর অবস্থা। কারণ একদিকে ছিল সংলাপ নাটকের মাধ্যমে সময় ক্ষেপণ ও বিরোধী আন্দোলনকে ঠাণ্ডা রাখার সরকারি কৌশল- অপরদিকে ছিল আন্দোলনের টার্নিং এই সময়ে কঠোর কর্মসূচির অপরিহার্যতা। বিরোধী জোট তাদের নেত্রীর আল্টিমেটামের দায়বদ্ধতায় যেমন আবদ্ধ ছিল, আবার ময়দানের অনিবার্য বাস্তবতায় কঠোর কোনো কর্মসূচি দেওয়ার চাপও তাদের ওপর ছিল। বিরোধীজোটকে এ ক্ষেত্রে একটা ক্ষতি স্বীকার করতেই হতো। দেখার বিষয় ছিল, তারা কোন ক্ষতিটা স্বীকার করে। আমার বিবেচনায়, এক্ষেত্রে তারা অপেক্ষাকৃত ছোট ক্ষতিটাই স্বীকার করেছে। কেননা এখন মূলত আলোচনা-সংলাপের নামে চলবে হল পলিটিক্স। বিরোধীজোটকে আন্দোলনের মাধ্যমেই তাদের দাবির একটা বিহিত করতে হবে। কাজেই সংলাপের সফলতা নির্ভর করে আন্দোলনের ঠেলার ওপর।
দুই.
আমার আশঙ্কা হলোÑ আমাদের জাতীয় রাজনীতির বর্তমান যে সমীকরণ তাতে ইজি এক্জিটের সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। তার কারণ হলোÑ আওয়ামীলীগের কাছে বিভিন্ন সূত্রে এই জরিপ আছে যে, ন্যূনতম নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের নজিরবিহীন ভরাডুবি হবে। কাজেই আওয়ামীলীগের সামনে বিকল্প হলোÑ দুই সম্ভাবনার মধ্যে থেকে যে কোনো একটির পথে পা বাড়ানো। হয় ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে সাজানো একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। যাতে নিজেদের পতন ঠেকানো সম্ভব হয়। আর না হয় অস্থিতিশীলতা ও নৈরাজ্যের মাধ্যমে একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত দেশে নির্বাচন না হওয়ার ব্যবস্থা চূড়ান্ত করা। আওয়ামীলীগের সামনে আপাতত বিবেচনায় তৃতীয় কোনো পথ খোলা নেই । অপরদিকে বিরোধীদলের পক্ষে পাতানো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা হবে আত্মহত্যার শামিল। এই বিষয়গুলো সামনে রেখেই সংলাপ হবে। কাজেই সংলাপ ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। সংলাপের মাধ্যমে মূলত কূটনীতি আর পলিটিক্সের গুটি চালাচালি হবে। দেখার বিষয় থাকবে কোন পক্ষ কতোটা দক্ষতা ও নিপুণতার সঙ্গে গুটি চালতে পারে। বিএনপি ও ১৮ দলের জন্য খেলাটা তুলনামূলক বেশি জটিল। কারণ, বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণে জনমত বিবেচনায় তারা নিরঙ্কুশভাবে অগ্রগামী। তাই নৈরাজ্যের কারণে দীর্ঘ দিনের জন্য নির্বাচন বন্ধ হয়ে থাকা বা তৃতীয় কোনো পক্ষের আগমনকে তারা নিজেরেদ মুখের গ্রাস অন্যের মুখে চলে যাওয়ার মতো মনে করছে। তাই বিএনপিকে সাপও মারতে হবে- লাঠিও ভাঙ্গা যাবে না। আন্দোলনও করতে হবে- আবার তৃতীয় শক্তিকেও আনা যাবে না। ড্রাইভিং সিটে যেহেতু আওয়ামীলীগ তাই বিএনপির পক্ষে এমন উভয়কূল রক্ষা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। সেই ক্ষেত্রে বাংলাদেশে তৃতীয় শক্তি সেনাবাহিনীও হতে পারে। মঈনুদ্দীন-ফখরুদ্দীন মার্কা সেনা ও বহি:শক্তির মদদপুষ্ট কোনো সরকারও হতে পারে।
তিন.
সরকার ও বিরোধী পক্ষের যুদ্ধাংদেহী পরিস্থতির মধ্য দিয়ে স্বীকৃতির নামে কওমি মাদরাসা শিক্ষা নিয়ন্ত্রণ ইস্যুতে বাড়তি উত্তাপ ছড়িয়ে গেলো। হালের সর্বাধিক আলোচিত নাম হেফাজতে ইসলাম। সরকার নিজের ইচ্ছা মতো পুতুল কর্তৃপক্ষ গঠনের অভিপ্রায় থেকে কোনোক্রমেই সরে আসতে চাইছে না। বিএনপি-জামায়াত সরকারের কাঁধে ছিল এক ভূত। যেই ভূতের আছরে সিংহভাগ আলেম সমাজের মনোভাবকে পাশ কাটিয়ে রাতারাতি জন্ম নিয়েছিল কিছু শিক্ষাবোর্ড। আওয়ামী সরকারের কাঁধে ভর করে আরেক ভূত। নিজেদের আজ্ঞাবহ ব্যক্তিদের কর্তৃত্ব আর শিক্ষা ব্যবস্থাটিকে নিয়ন্ত্রণ করার অভিপ্রায় হলো এই ভূতের আছর। এই ভূতের আছরে সরকার বিতর্কিত করে দিচ্ছে কোনো কোনো শীর্ষস্থানীয় আলেমকে। এহেন পরিস্থিতিতে স্বীকৃতির চেয়ে কওমি মাদরাসা শিক্ষার স্বকীয়তা আর আলেম সমাজের ভাবমূর্তি রক্ষার প্রশ্নই বড় হয়ে ওঠেছে। সরকারের সাথে দেন দরবারের আগে আলেমদেরকে একটি প্লাটফর্মে আসতে হবে। তারপর সেই প্লাটফর্ম থেকে মাদরাসা শিক্ষার স্বার্থ ও স্বকীয়তাসহ অন্যান্য প্রসঙ্গগুলো নির্ধারণ করে সরকারের সাথে দর কষাকষিতে নামতে হবে। এই সরকার আর সেই সরকার যে কোনো সরকারের আমলেই এর ব্যত্যয় ঘটলে লাভের চেয়ে ক্ষতির আশংকাই প্রবল থাকবে।
চার.
বহুল আলোচিত দুই নেত্রীর ফোনালাপ প্রকাশ করলো সরকার। বিরোধীদলের আপত্তির পরও এটি প্রকাশ করা এক দিকে যেমন রাজনৈতিক শিষ্টাচার বর্জিত হয়েছে, তেমনি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও একটি গর্হিত কাজ হয়েছে। এমন শিষ্টাচার বর্জিত ও অন্যায় কাজ সরকার কেন করলো তা আমাদের বোধগম্য নয়। এই ধরণের কাজ পরস্পর অনস্থা ও অবিশ্বাস বাড়াবে বৈকি? পরিস্থিতি যখন আলোচনা ও সংলাপের দিকে এগোচ্ছে- ঠিক সেই সময়ে সরকারের এমন কাজ সংলাপের পরিবেশকে নষ্টই করলো। সরকারের ভাবসাব দেখে মনে হয়েছিলো এই ফোনালাপে এমন কোনো তথ্য আছে যাতে বিরোধী নেত্রী বেকায়দায় পড়ে যাবেন। আর প্রধানমন্ত্রী বাহবা পাবেন। কিন্তু এমন কিছুই তো সেখানে নেই। তবে কার বুদ্ধিতে এমন বেকুবি করলো সরকার! ভদ্রসমাজ এটিকে সরকারের অমার্জনীয় অভদ্রতা বলেই বিবেচনা করছে। দুইজন মহিলার ফোনালাপকে অনুমতি ছাড়াই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা নজিরবিহীন। এই ঘটনাটি আমাদের জাতীয় অভদ্রতার পরিচায়ক হয়ে থাকবে অনাগত ভবিষ্যতে।
৩০ অক্টোবর’১৩ ঢাকা
২৫ অক্টোবর ১৮ দলীয় জোট সমাবেশ করার সিদ্ধান্তে অটল থাকায় অবশেষে সরকারকেই পিছু হটতে হয়েছে। দিতে হয়েছে সমাবেশের অনুমতি। এর আগে সব ধরণের সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল ঢাকার পুলিশ প্রশাসন। সূচনাতেই নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও পরে পিছিয়ে যাওয়ার এই ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো, বিরোধীজোটের আন্দোলনের সাফল্য নির্ভর করছে ময়দানে তাদের অনড় অবস্থানের ওপর। দুর্বলতা ও দোদুল্যমানতা নিয়ে কোনো অবস্থানে পৌঁছতে পারবে না বিরোধীজোট।
২৫ অক্টোবরের সমাবেশে ১৮ দলীয় জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার একটি দুর্বলতা লক্ষ করা গেছে। যা সাধারণত তার ক্ষেত্রে দেখা যায় না। ৬০ ঘণ্টার হরতাল ঘোষণার ক্ষেত্রে কোনো আল্টিমেটাম দেওয়ার পূর্বালোচনা বা সিদ্ধান্ত ছিল না। বরং আন্দোলন ও সংলাপ একই সঙ্গে চলার ঘোষণাই ছিল ১৮ দলের স্ট্রাটেজি। কিন্তু বেগম জিয়ার বক্তব্যে সরকারের পক্ষ থেকে দুই দিনের মধ্যে সংলাপ ও আলোচনার আয়োজন না করলে হরতালের ঝুলন্ত ঘোষণা চলে আসে। এটা ছিল তার মুখ ফস্কে বের হয়ে যাওয়া একটি ব্যাপার। যদিও সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তার আন্দোলন-সংলাপ একসঙ্গে চলার নীতি আন্দোলন ও সংলাপ একসঙ্গে চলার নীতি ও অবস্থানের কথা স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মিডিয়ার সিংহভাগই যেহেতু ধর্মনিরপেক্ষ ও আওয়ামী বলয়ের, তাই তারা এখানে ১৮ দল বা বেগম জিয়াকে কোনো ছাড় দেয়নি। বরং তার মুখ ফস্কা কথাকেই হাইলাইট করেছে। আর সেই সুযোগটাই লুফে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। নির্ধারিত দুই দিনের মধ্যেই ফোনালাপের মাধ্যমে বল বিরোধী দলের কোর্টে ঠেলে দিয়েছেন। এটা ছিল বিরোধীদলের জন্য একটা বিব্রতকর অবস্থা। কারণ একদিকে ছিল সংলাপ নাটকের মাধ্যমে সময় ক্ষেপণ ও বিরোধী আন্দোলনকে ঠাণ্ডা রাখার সরকারি কৌশল- অপরদিকে ছিল আন্দোলনের টার্নিং এই সময়ে কঠোর কর্মসূচির অপরিহার্যতা। বিরোধী জোট তাদের নেত্রীর আল্টিমেটামের দায়বদ্ধতায় যেমন আবদ্ধ ছিল, আবার ময়দানের অনিবার্য বাস্তবতায় কঠোর কোনো কর্মসূচি দেওয়ার চাপও তাদের ওপর ছিল। বিরোধীজোটকে এ ক্ষেত্রে একটা ক্ষতি স্বীকার করতেই হতো। দেখার বিষয় ছিল, তারা কোন ক্ষতিটা স্বীকার করে। আমার বিবেচনায়, এক্ষেত্রে তারা অপেক্ষাকৃত ছোট ক্ষতিটাই স্বীকার করেছে। কেননা এখন মূলত আলোচনা-সংলাপের নামে চলবে হল পলিটিক্স। বিরোধীজোটকে আন্দোলনের মাধ্যমেই তাদের দাবির একটা বিহিত করতে হবে। কাজেই সংলাপের সফলতা নির্ভর করে আন্দোলনের ঠেলার ওপর।
দুই.
আমার আশঙ্কা হলোÑ আমাদের জাতীয় রাজনীতির বর্তমান যে সমীকরণ তাতে ইজি এক্জিটের সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। তার কারণ হলোÑ আওয়ামীলীগের কাছে বিভিন্ন সূত্রে এই জরিপ আছে যে, ন্যূনতম নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের নজিরবিহীন ভরাডুবি হবে। কাজেই আওয়ামীলীগের সামনে বিকল্প হলোÑ দুই সম্ভাবনার মধ্যে থেকে যে কোনো একটির পথে পা বাড়ানো। হয় ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে সাজানো একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। যাতে নিজেদের পতন ঠেকানো সম্ভব হয়। আর না হয় অস্থিতিশীলতা ও নৈরাজ্যের মাধ্যমে একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত দেশে নির্বাচন না হওয়ার ব্যবস্থা চূড়ান্ত করা। আওয়ামীলীগের সামনে আপাতত বিবেচনায় তৃতীয় কোনো পথ খোলা নেই । অপরদিকে বিরোধীদলের পক্ষে পাতানো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা হবে আত্মহত্যার শামিল। এই বিষয়গুলো সামনে রেখেই সংলাপ হবে। কাজেই সংলাপ ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। সংলাপের মাধ্যমে মূলত কূটনীতি আর পলিটিক্সের গুটি চালাচালি হবে। দেখার বিষয় থাকবে কোন পক্ষ কতোটা দক্ষতা ও নিপুণতার সঙ্গে গুটি চালতে পারে। বিএনপি ও ১৮ দলের জন্য খেলাটা তুলনামূলক বেশি জটিল। কারণ, বস্তুনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণে জনমত বিবেচনায় তারা নিরঙ্কুশভাবে অগ্রগামী। তাই নৈরাজ্যের কারণে দীর্ঘ দিনের জন্য নির্বাচন বন্ধ হয়ে থাকা বা তৃতীয় কোনো পক্ষের আগমনকে তারা নিজেরেদ মুখের গ্রাস অন্যের মুখে চলে যাওয়ার মতো মনে করছে। তাই বিএনপিকে সাপও মারতে হবে- লাঠিও ভাঙ্গা যাবে না। আন্দোলনও করতে হবে- আবার তৃতীয় শক্তিকেও আনা যাবে না। ড্রাইভিং সিটে যেহেতু আওয়ামীলীগ তাই বিএনপির পক্ষে এমন উভয়কূল রক্ষা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। সেই ক্ষেত্রে বাংলাদেশে তৃতীয় শক্তি সেনাবাহিনীও হতে পারে। মঈনুদ্দীন-ফখরুদ্দীন মার্কা সেনা ও বহি:শক্তির মদদপুষ্ট কোনো সরকারও হতে পারে।
তিন.
সরকার ও বিরোধী পক্ষের যুদ্ধাংদেহী পরিস্থতির মধ্য দিয়ে স্বীকৃতির নামে কওমি মাদরাসা শিক্ষা নিয়ন্ত্রণ ইস্যুতে বাড়তি উত্তাপ ছড়িয়ে গেলো। হালের সর্বাধিক আলোচিত নাম হেফাজতে ইসলাম। সরকার নিজের ইচ্ছা মতো পুতুল কর্তৃপক্ষ গঠনের অভিপ্রায় থেকে কোনোক্রমেই সরে আসতে চাইছে না। বিএনপি-জামায়াত সরকারের কাঁধে ছিল এক ভূত। যেই ভূতের আছরে সিংহভাগ আলেম সমাজের মনোভাবকে পাশ কাটিয়ে রাতারাতি জন্ম নিয়েছিল কিছু শিক্ষাবোর্ড। আওয়ামী সরকারের কাঁধে ভর করে আরেক ভূত। নিজেদের আজ্ঞাবহ ব্যক্তিদের কর্তৃত্ব আর শিক্ষা ব্যবস্থাটিকে নিয়ন্ত্রণ করার অভিপ্রায় হলো এই ভূতের আছর। এই ভূতের আছরে সরকার বিতর্কিত করে দিচ্ছে কোনো কোনো শীর্ষস্থানীয় আলেমকে। এহেন পরিস্থিতিতে স্বীকৃতির চেয়ে কওমি মাদরাসা শিক্ষার স্বকীয়তা আর আলেম সমাজের ভাবমূর্তি রক্ষার প্রশ্নই বড় হয়ে ওঠেছে। সরকারের সাথে দেন দরবারের আগে আলেমদেরকে একটি প্লাটফর্মে আসতে হবে। তারপর সেই প্লাটফর্ম থেকে মাদরাসা শিক্ষার স্বার্থ ও স্বকীয়তাসহ অন্যান্য প্রসঙ্গগুলো নির্ধারণ করে সরকারের সাথে দর কষাকষিতে নামতে হবে। এই সরকার আর সেই সরকার যে কোনো সরকারের আমলেই এর ব্যত্যয় ঘটলে লাভের চেয়ে ক্ষতির আশংকাই প্রবল থাকবে।
চার.
বহুল আলোচিত দুই নেত্রীর ফোনালাপ প্রকাশ করলো সরকার। বিরোধীদলের আপত্তির পরও এটি প্রকাশ করা এক দিকে যেমন রাজনৈতিক শিষ্টাচার বর্জিত হয়েছে, তেমনি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও একটি গর্হিত কাজ হয়েছে। এমন শিষ্টাচার বর্জিত ও অন্যায় কাজ সরকার কেন করলো তা আমাদের বোধগম্য নয়। এই ধরণের কাজ পরস্পর অনস্থা ও অবিশ্বাস বাড়াবে বৈকি? পরিস্থিতি যখন আলোচনা ও সংলাপের দিকে এগোচ্ছে- ঠিক সেই সময়ে সরকারের এমন কাজ সংলাপের পরিবেশকে নষ্টই করলো। সরকারের ভাবসাব দেখে মনে হয়েছিলো এই ফোনালাপে এমন কোনো তথ্য আছে যাতে বিরোধী নেত্রী বেকায়দায় পড়ে যাবেন। আর প্রধানমন্ত্রী বাহবা পাবেন। কিন্তু এমন কিছুই তো সেখানে নেই। তবে কার বুদ্ধিতে এমন বেকুবি করলো সরকার! ভদ্রসমাজ এটিকে সরকারের অমার্জনীয় অভদ্রতা বলেই বিবেচনা করছে। দুইজন মহিলার ফোনালাপকে অনুমতি ছাড়াই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা নজিরবিহীন। এই ঘটনাটি আমাদের জাতীয় অভদ্রতার পরিচায়ক হয়ে থাকবে অনাগত ভবিষ্যতে।
৩০ অক্টোবর’১৩ ঢাকা
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের অর্থনৈতিক রূপ
মাওলানা লিয়াকত আলী বর্তমানে বিশ্বের এক নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে সন্ত্রাসবাদকে। পরাশক্তিগুলো এই সমস্যাটি প্রতিকারের নামে প্রথমে আফগানিস্তান তারপর ইরাকে আগ্রাসন চালিয়ে দেশ দু’টি কার্যত দখল করে নিয়েছে। উভয় দেশে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোট বাহিনী এখনো অবস্থান করছে। সন্ত্রাসবাদে সমর্থন দানের অভিযোগে ইরান ও সিরিয়ার বিরুদ্ধে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ফিলিস্তিনের নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে একই অভিযোগে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে মার্কিন সরকার ও জনগণের সর্বশক্তি নিয়োগের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিচ্ছেন বারবার। তিনি ও পশ্চিমা সরকারগুলো শুধু সামরিক সন্ত্রাসবাদের কথাই বলছে। কিন্তু বিশ্ববাসী আরও কয়েক ধরনের সন্ত্রাসের শিকার হলেও সেগুলো আলোচনায় আসছে না। বিশেষ করে অর্থনৈতিক সন্ত্রাসের বিষয়টি ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। অথচ সামরিক সন্ত্রাসের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিকর ও ধ্বংসাত্মক অর্থনৈতিক সন্ত্রাস। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাপ্তাহিক টাইম ম্যাগাজিনের সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতে পুঁজিবাদী সন্ত্রাসের কারণে প্রতিদিন ৫৪ হাজার ৭৯৫ জন ভারতীয় নাগরিক দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার বিশ্বায়নের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অর্থনৈতিক সন্ত্রাসের কিছুটা নমুনা তুলে ধরেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ‘কার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর গ্লোবাল পিস’-এর স্কলার ডেভিড রোথকাফ। প্রথমে ওয়াশিংটন পোস্টে তারপর সুপারক্লাস নামে তার এক বইয়ে তিনি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সন্ত্রাসবাদের একটি চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন অত্যন্ত নিপুণতার সাথে। তিনি বলেন, বিশ্বায়নের যুগ পুঁজিবাদী বিশ্বের শাসকশ্রেণির ওপর এমন এক সুপারক্লাসকে চাপিয়ে দিয়েছে। তারা বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি ও বিরাট সামরিক শক্তির অধিকারী দেশের চেয়েও শক্তিশালী ও প্রভাবশালী। তারা বিশ্বের সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসহ বড় ধরনের সব দুর্ঘটনার জন্যও দায়ী। দিন দিন এদের শক্তি ও প্রভাব বেড়েই চলেছে। ডেভিড রোথকাফ বলেন, এই সুপারক্লাসের সদস্যসংখ্যা ৬ হাজারের মতো। কিন্তু এরা ভূগোলকের সব সাগরের চারপাশে ও অভ্যন্তরের দ্বীপগুলোতে বসবাসকারী শত শত কোটি মানুষের জীবনের মোড় ঘোরাতে ও সমাজের গতি নির্ধারণের ক্ষমতা ও যোগ্যতা রাখে। এখন বিশ্ববাসী যেসব সমস্যায় জর্জরিত, যেসব সঙ্কটে পতিত এবং যেসব জটিলতার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে, তার প্রায় সবই এই সুপারক্লাসেরই সৃষ্টিÑ তা প্রত্যক্ষভাবেই হোক, আর পরোক্ষভাবেই হোক। যুক্তরাষ্ট্রসহ সব দেশের সরকার ও প্রশাসন এই বহুজাতিক সুপারক্লাসের কাছে অসহায়, প্রভাবহীন, নতজানু। ডেভিডের বর্ণনা অনুযায়ী বিশ্বের ৫০টি বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানির হাতে রয়েছে প্রায় ৫ লাখ কোটি ডলারের অর্থসম্পদ, যা সারা পৃথিবীর আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়িক কোম্পানি, শিল্প প্রতিষ্ঠান ও ধনবানদের মোট সম্পদ ও পুঁজির প্রায় এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি। তিনি আরও বলেন, এক্সন বা ম্যালমার্টের মতো বড় বড় করপোরেশনের অর্থসম্পদের পরিমাণ পৃথিবীর বিশটি প্রধান শিল্পোন্নত দেশের মোট বার্ষিক জাতীয় আয় বাদ দিয়ে অন্য সব দেশ ও অর্থনীতির সর্বমোট বার্ষিক জাতীয় আয়ের চেয়েও বেশি এবং বিশ্বের ২৫০টি বড় করপোরেশন বা কোম্পানির বার্ষিক সেবামূল্য বিশ্বের সব দেশের মোট বার্ষিক জাতীয় আয়ের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি। রবার্ট মারডকের ব্যক্তিগত মালিকানার নিউজ করপোরেশনের মতো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সরকারগুলোর চেয়েও প্রভাবশালী দেখা যায়। কেননা, সাধারণ জনগণের সাথে এই প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ ও সম্পর্ক সরকারগুলোর চেয়েও বেশি। সেজন্য তা জনমত প্রভাবিত বা বিভ্রান্ত করার প্রচুর ক্ষমতা রাখে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য তথ্যের ইচ্ছামতো বিকৃতি সাধন করে প্রচার করে। মিডিয়া জগতে ইতালির লাখ-কোটিপতি সিলভিয়ো বার্লুসকোনি আবারো নিজের অভাবনীয় অর্থের জোরে নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রী হতে সক্ষম হলেন। তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জি-এইট সম্মেলনে অংশ নিতে পারেন। অর্থের জোরে তিনি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রভাব খাটাতে পারেন। তেমটি বিশ্বের এগার শ’র বেশি শত কোটি ডলারের মালিকের সম্পদ পৃথিবীর আড়াই শ’ কোটি মানুষের মোট সম্পদের দ্বিগুণ। পৃথিবীর শতকরা দশজন ধনীর কাছে বিশ্বায়নের ফলে শতকরা ৮৫ ভাগের বেশি সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়ে গেছে। অথচ পৃথিবীর অর্ধেক গরিব মানুষের কাছে সম্পদ রয়ে গেছে শতকরা মাত্র এক ভাগ। তাও দিন দিন কমে যাচ্ছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা গত এক দশকে ১ কোটি বিলিয়নেয়ারের সম্পদ দ্বিগুণ করে দিয়েছে এবং তাদের সম্পদের পরিমাণ ৩৭০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিশ্বায়নের কারণে উদ্ভব হওয়া ১ কোটির বেশি বিলিয়নেয়ার নিয়ে গঠিত সুপারক্লাসের অর্থনৈতিক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরাও প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন। কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, একজন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা যদি মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে একজন সাধারণ শ্রমিকের সারা বছরের ঘাম পানি করা আয়ের চেয়েও বেশি আয় করেন, তাহলে আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অনেক মারাত্মক দোষ রয়েছে। এই দোষ শুধু জানলেই হবে না, তা দূর করার ব্যবস্থাও নিতে হবে। হিলারি ক্লিনটন বলেছেন, অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় ও মারাত্মক ভুল ব্যবস্থা এই যে, ওয়াল স্ট্রিটে বছরে ৫ কোটি ডলার উপার্জনকারী পুঁজিপতি সারা বছরে ৫০ হাজার ডলার উপার্জনকারী শ্রমিকের বার্ষিক আয়করের চেয়েও কম আয়কর পরিশোধ করবে। কিন্তু এটা শুধু আমেরিকা ও ইউরোপে নয়, সারা পৃথিবীর পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় হচ্ছে, হয়ে আসছে এবং হতে থাকবে। আর এ চিন্তা একেবারেই ভুল যে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় লোকেরা যদি যথানিয়মে আয়কর পরিশোধ করে, তাহলে বৈষম্য, শ্রেণিবিভেদ, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, বেকারত্ব ও রোগব্যাধির অবসান হয়ে যাবে। বিশ্বের বেশির ভাগ সমাজ ও অর্থনীতিতে লোকেরা আয়কর ছাড়াও ব্যাংক ঋণ, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ইত্যাদির বিল ফাঁকি দিয়ে সম্পদ বাড়ায়। সম্পদের জোরে রাজনৈতিক প্রভাব হাসিল করে এবং রাজনৈতিক প্রভাবকে পুঁজি করে পুঁজিপতি হয়ে যায়। তাদের এই অর্থব্যবস্থার মধ্যে ডুবে থাকা অবস্থায় তাদের এ কার্যকলাপের পরিবর্তন করা যাবে না। সুপারক্লাস কেন সৃষ্টি হলো? কেন তাদের হাতে সম্পদের শতকরা ৮৫ ভাগ পুঞ্জীভূত হয়ে গেল? কারণ, আল্লাহর বিশাল সৃষ্টিলোকে মানবজাতির একমাত্র বিচরণক্ষেত্র পৃথিবী নামক গ্রহে বর্তমানে সাত শ’ কোটির বেশি আদম সন্তান বসবাস করছে। তারা তাদের জীবনকে আরামদায়ক ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করার জন্য যত উপকরণ আবিষ্কার করেছেÑ তা চিকিৎসা সামগ্রী হোক, যাতায়াত ও যোগাযোগ মাধ্যম হোক বা গবেষণার সহায়ক বস্তু হোকÑ এগুলোর উপকার সাধারণ মানুষেরা পায় সামান্যই। বরং এগুলোর ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য রয়েছে মুষ্টিমেয় সংখ্যক মানুষের। এরা এগুলোকে নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী ব্যবহার করার জন্য কুক্ষিগত করে রেখেছে। পৃথিবীকে মানুষের জন্য পরম সুখের স্থানে পরিণত করার এসব আবিষ্কার ও উদ্ভাবন কাজে আসছে পৃথিবীতে আধিপত্য বিস্তারকারী এই সুপারক্লাসটির। গত দশকে সুপারক্লাসের সম্পদ ও অর্থের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়ে গেছে এসব আবিষ্কারের ফলেই। পুঁজিবাদের বিশ্বায়নই অর্থনীতির বোতল থেকে সুপারক্লাসের দৈত্য ছেড়ে দিয়েছে। এটাকে আর আটক করা সম্ভব হচ্ছে না। বোতলের বাইরে চলে যাওয়া এই দৈত্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গণবিধ্বংসী অস্ত্রের চেয়েও মারাত্মক ও নাশকতামূলক এবং আল কায়েদার চেয়েও বড় সন্ত্রাসবাদী। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে যারা ইতিহাসের সমাপ্তি হলো বলে সুসংবাদ শুনিয়েছিলেন, তারাও দুশ্চিন্তায় ভুগছেন যে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নতুন করে দুর্যোগের ঘনঘটা দেখা যাচ্ছে। এজন্য পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সমর্থক বুদ্ধিজীবী ও অর্থনীতিবিদরাও চাইছেন সুপারক্লাসকে সুপ্রিমক্লাস হওয়ার পথ বন্ধ করতে হবে। কিন্তু কোথায় সেই সাহসী ইঁদুর যে বিড়ালের গলায় ঘণ্টা ঝুলিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করবে? তবে একটি সান্ত্বনা আছে। প্রাণী বিজ্ঞানীরা প্রাচীন পৃথিবীতে ডাইনোসর নামে এক অতি বিশাল প্রাণীর অস্তিত্ব ছিল বলে দাবি করেন। বলা হয়ে থাকে ডাইনোসররা যখন সারা পৃথিবীর উদ্ভিদগুলো খেয়ে শেষ করে এমনকি বড় বড় গাছের শিকড় পর্যন্ত খেয়ে ফেলে তখন তাদের খাদ্যাভাব দেখা দেয়। এবার তারা পরস্পরকে হত্যা করে খেতে বাধ্য হয়। এভাবেই নাকি এই বিশালাকৃতির প্রাণীটির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। এখন দেখা যাচ্ছে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিশ্বায়নের চক্করে পড়ে মাল্টিন্যাশনাল করপোরেশনগুলো নিজেদের মুনাফা ও প্রবৃদ্ধির হার বজায় রাখার জন্য একে অপরের সাথে একীভূত হয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। সুপারক্লাস বইয়ের লেখক ডেভিড রোথকাফের আশঙ্কাÑ ডাইনোসররা যেমন পরস্পরকে গ্রাস করে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এবং ইতিহাসের বিষয়ে পরিণত হয়েছে, ঠিক তেমনি পুঁজিবাদীদের সুপারক্লাসই হয়তো পুঁজিবাদী অর্থনীতির কবর রচনা করবে।# |
ইতিহাসের আলোকে মুহাররম ও আশুরা
ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন মুহাররম মাসের দশম তারিখ ইতিহাসে ‘আশুরা’ নামে অভিহিত। প্রাচীন কালের নানা জনগোষ্ঠীর নিকট ‘আশুরা’ পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ। ইহুদিদের নিকট ‘আশুরা’ জাতীয় মুক্তি দিবস হিসেবে পরিচিত। আশুরার মর্যাদা ইসলামেও স্বীকৃত। মুসলমানগণ রোজা পালনের মাধ্যমে আশুরার মাহাত্ম্য স্মরণ করে থাকে। আশুরা’র দিনে পৃথিবীর বহু চাঞ্চল্যকর ঘটনা সংঘটিত হয়। আসমান-জমিন, আরশ-কুরসি ও আদি পিতা আদম আ. এর সৃষ্টি, ধরা পৃষ্ঠে প্রথম বারিবর্ষণ, হযরত নূহ আ. এর জাহাজ মহাপ্লাবন শেষে জুদি পাহাড়ে অবতরণ, ফিরআউনের নির্যাতন থেকে হযরত মূসা আ. কর্তৃক ইহুদিদের উদ্ধার, দূরারোগ্য ব্যাধি হতে হযরত আইয়ুব আ. এর সুস্থতা লাভ, মৎস্য উদর হতে হযরত ইউনুস আ. এর নির্গমণ, হযরত সুলায়মান আ. কে পৃথিবীর একচ্ছত্র রাজত্ব প্রদান, নমরুদের অগ্নিকুণ্ড হতে হযরত ইবরাহিম আ. এর নিস্কৃতি, হযরত ইয়াকুব আ. এর চক্ষুজ্যোতি পুনঃপ্রাপ্তি, কূপ হতে হযরত ইউসুফ আ. কে উদ্ধার, হযরত ইদরিস আ. ও হযরত ঈসা আ. কে আসমানে উত্তোলন, কারবালায় হযরত হোসাইন আ. এর শাহাদতসহ বিপুল ঐতিহাসিক ঘটনার নীরব সাক্ষি ‘আশুরা’ (মুফতি আশফাক আলম কাসেমি, ফাযায়েলে মুহাররম, পৃ. ৩৫-৩৬)। মদিনায় হিজরতের পর রাসুলুল্লাহ সা. লক্ষ্য করেন যে, ইহুদিরা ‘আশুরা’ দিবসে রোজা রাখছে। তিনি তাদের জিজ্ঞাসা করলেন এটা কোন দিন যাতে তোমরা রোজা রেখেছ? তারা বলল, এটা এমন এক মহান দিবস, যেদিন আল্লাহ তায়ালা হযরত মুসা আ. ও তার সম্প্রদায়কে মুক্তি প্রদান করেছিলেন। ফেরাউনকে তার সম্প্রদায়সহ ডুবিয়ে মেরেছিলেন। তাই হযরত মুসা আ. কৃতজ্ঞতা স্বরূপ এদিন রোজা রাখেন। এ জন্য আমরাও রোজা রাখি। এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘তোমাদের চেয়ে আমরা মুসা আ.-এর অধিকতর ঘনিষ্ঠ ও নিকটবর্তী। অত:পর রাসুলুল্লাহ সা. রোজা রাখেন এবং অন্যদেরও রোজা রাখার নির্দেশ দেন’ (মুসলিম, ১/৩৫৯)। হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সা.বলেন, রমজানের পর সব রোজার (নফল) মধ্যে আশুরা’র রোজা সর্বশ্রেষ্ঠ (তিরমিজি ১/১৫৬)। পবিত্র আশুরার দিন রোজা রাখার ফজিলত সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, আমি আশা করি যে ব্যক্তি আশুরা দিবসে রোজা রাখবে তার এক বছরের গুনাহের কাফ্ফারা (ক্ষমা) হয়ে যাবে (মুসলিম, ১/৩৬৭)। আশুরার দিন রোজা রাখলে ইহুদিদের সাথে সাদৃশ্য হয়ে যায় বিধায় রাসুলুল্লাহ সা.তার আগের দিন বা পরের দিন আরেকটি রোজা রাখার পরামর্শ দেন (মুসনাদ আহমদ)। ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ অক্টোবর (৬০ হিজরির ১০ মুহাররম) কারবালা প্রান্তরে মহানবীর দৌহিত্র হযরত হোসাইন রা. মর্মান্তিক শাহাদাত আশুরাকে আরও তাৎপর্যমণ্ডিত করেছে। রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে খিলাফত ব্যবস্থার পুনর্জ্জীবন ছিল হযরত হোসাইন রা. এর সংগ্রামের মূল লক্ষ্য। মুসলিম জাহানের বিপুল মানুষের সমর্থন ছিল তাঁর পক্ষে। তৎকালীন শাসক ইয়াজিদের বিরুদ্ধে হযরত হোসাইন রা. এর গৃহীত পদক্ষেপ ছিল যথার্থ, আইনানুগ ও বীরত্বপূর্ণ। মদিনার পরিবর্তে দামেস্কে রাজধানী স্থানান্তর, উমাইয়াদের অনৈসলামিক কার্যকলাপ, ইয়াজিদের দুরভিসন্ধি, কুফাবাসীদের বিশ্বাসঘাতকতা সর্বোপরি ইহুদি আবদুল্লাহ ইবনে সাবা’র ষড়যন্ত্র কারবালা হত্যাকাণ্ডের জন্ম দেয়। ইয়াজিদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কুফাবাসীদের সাহায্যের প্রতিশ্র“তিতে আশ্বস্ত হয়ে হযরত হোসাইন রা. স্ত্রী, পুত্র, বোন ও ঘনিষ্ট ২০০ অনুচর সহকারে ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে কুফার উদ্দেশ্যে রওনা হন। ফোরাত নদীর তীরবর্তী কারবালা নামক স্থানে পৌঁছলে কুফার গভর্ণর ওবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদ তাঁকে বাধা প্রদান করে। রক্তপাত বন্ধের উদ্দেশ্যে ইমাম হোসাইন রা. তিনটি প্রস্তাব পেশ করেন, প্রথমত তাঁকে মদিনায় ফিরে যেতে দেওয়া হোক। দ্বিতীয়ত, তুর্কি সীমান্তের দুর্গে অবস্থান করতে দেওয়া হোক। তৃতীয়ত, ইয়াজিদের সাথে আলোচনার জন্য দামেস্কে প্রেরণ করা হোক। কিন্তু ওবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদ নিঃশর্তে আত্মসমর্পণ করে তার হাতে আনুগত্যের শপথ নিতে আদেশ দেন। হযরত হোসাইন রা. ঘৃণাভরে তার এ আদেশ প্রত্যাখ্যান করেন। ঐতিহাসিক উইলিয়াম মুইর ইমাম হোসাইন রা. এর প্রস্তাব সম্পর্কে বলেন, “এ অনুরোধ যদি মেনে নেওয়া হতো, উমাইয়াদের জন্য মঙ্গল বয়ে আনতো (ডবষষ যধফ রঃ নববহ ভড়ৎ ঃযব টসধুুধফ যড়ঁংব, রভ ঃযব ঢ়ৎধুবৎ যধফ নববহ ধমৎববফ ঃড়.)। অবশেষে ওবায়দুল্লাহ ইব্ন যিয়াদ-এর ৪ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী ইমাম হোসাইন রা.কে অবরুদ্ধ করে ফেলে এবং ফোরাত নদীতে যাতায়তের পথ বন্ধ করে দেয়। হযরত হোসাইন রা.-এর শিবিরে পানির হাহাকার ওঠে। তিনি ইয়াজিদ বাহিনীর উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষণে বলেন, আমি যুদ্ধ করতে আসিনি এমনকি নিছক ক্ষমতা দখল আমার উদ্দেশ্য নয়; খিলাফতের ঐতিহ্য পুনরোদ্ধার আমার কাম্য। দশ মুহাররম ইয়াজিদ বাহিনী তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সংঘটিত এ অসম যুদ্ধে একমাত্র পুত্র ইমাম যায়নুল আবেদীন ব্যতীত ৭০ জন পুরুষ শহীদ হন। ইমাম হোসাইন রা. মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করে যান; অবশেষে শাহাদতবরণ করেন। ইমাম হোসাইন রা. ছিন্ন মস্তক বর্ষা ফলকে বিদ্ধ করে দামেস্কে প্রেরিত হয়। ইয়াজিদ ভীত ও শঙ্কিত হয়ে ছিন্ন মস্তক প্রত্যার্পণ করলে কারবালায় পবিত্র দেহসহ তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। ইতিহাসবিদ গীবন বলেন, সেই দূরবর্তী যুগে ও পরিবেশে হযরত হোসাইনের মৃত্যুর শোকাবহ দৃশ্য কঠিনতম পাঠকের হৃদয়ে সমবেদনার সঞ্চার করবে (ওহ ধ ফরংঃধহঃ ধমব ধহফ পষরসধঃব ঃযব ঃৎধমরপ ংপবহব ড়ভ ঃযব ফবধঃয ড়ভ ঐঁংধুহ রিষষ ধধিশবহ ঃযব ংুসঢ়ধঃযু ড়ভ ঃযব পড়ষফবংঃ ৎবধফবৎ.)। ইতিহাস সাক্ষি ইমাম হোসাইন রা. কে কারবালা প্রান্তরে যারা নির্মমভাবে হত্যা করেছিলো মাত্র ৫০ বছরের ব্যবধানে তাদের প্রত্যেকের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে করুণপন্থায়। কারবালার যুদ্ধে জয়লাভ ইয়াজিদ তথা উমাইয়া বংশের জন্য ছিল পরাজয়ের নামান্তর। এ বিয়োগান্তক ঘটনা বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্ম দেয়, পারস্যে জাতীয়তাবাদের উম্মেষ ঘটায় এবং সর্বোপরি ইসলামি রাষ্ট্রের জন্য সমূহ বিপর্যয় ডেকে আনে। কারবালার শোকাবহ হত্যাকাণ্ড মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র ত্রাসের শিহরণ জাগিয়ে তোলে। ইমাম হোসাইন রা. শাহাদত ছিল ন্যায়, সত্য ও ধর্মনিষ্টার জন্য। তিনি অন্যায় ও অসাধুতার সাথে আপোষ করেননি। তাঁর এ আত্মাহুতি সর্বকালে গৌরবোজ্জ্বল আদর্শরূপে পরিগণিত হয়। তাই ‘আশুরা’ মুসলমানদের আত্মোপলব্ধিকে জাগ্রত করে এবং সংগ্রামী চেতনাকে করে শানিত । |