আমাদের সামনে পবিত্র মাস মুহাররম। এ মাসে এমন একটি দিবস রয়েছে যাকে মানুষ বিভিন্নভাবে উদযাপন করে। সেটি হলো আশুরা দিবস। এদিন বহু ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছিল। যে কারণে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে এ দিবসের আমলে ভিন্নতা দেখা যায়। দুটি ঘটনা খুবই প্রসিদ্ধ।
প্রথম ঘটনা :
স্বগোত্রে মুসা আ. এর পরিত্রাণ ও স্বদলবলে ফেরাউনের পতন : ইমাম বুখারি ও মুসলিম রহ. আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এর উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা. মদিনায় আগমন করে দেখলেন স্থানীয় ইহুদিরা আশুরা দিবসে রোজা পালন করছে। ফলে তাদেরকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলো। তারা উত্তর দিলো- এ এমন এক দিবস- যাতে আল্লাহ তা‘আলা মুসা আ.কে বিজয়ী করেছিলেন এবং বনী ইসরাঈলকে ফেরাউনের ওপর আধিপত্য দান করেছেন। এ দিনের সম্মানার্থে আমরা সিয়াম পালন করি। এতদশ্রবণে নবী সা. ইরশাদ করলেন, ‘তাহলে তো এ দিন রোজা রাখার ব্যাপারে আমরাই অধিক হকদার। অতপর রাসুলুল্লাহ সা. এ দিবসে রোজা পালনের নির্দেশ দিলেন। (বুখারি : ৩৯৪৩; মুসলিম : ১১৩০)
দ্বিতীয় ঘটনা :
নবী দৌহিত্র হযরত হুসাইন রা. এর শাহাদাত বরণ : ইরাকের কারবালা প্রান্তরে মর্মবিদারক এ ঘটনাটি ঘটেছিল ৬১ হিজরির পবিত্র জুমাবারে। [আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ১১/৫৬৯] এটি ছিল উম্মতের ওপর নেমে আসা সবচে বড় বিপদগুলোর একটি। আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, ‘হুসাইন রা. এর শাহাদতের ঘটনাটি মহাবিপদগুলোর একটি। কারণ, হুসাইন রা. এবং তাঁর আগে উসমান রা. এর শহীদ হওয়ার মধ্য দিয়েই পরবর্তীতে উম্মতের ওপর নেমে এসেছে অনেক মহাদুর্যোগ। আর তাঁদের শহীদ করেছে আল্লাহর নিকৃষ্ট বান্দারা। [মাজমু ফাতাওয়া ৩/৪১১]
রাসুলুল্লাহ সা. এ দিন রোজা রাখতে বলেছেন, মুসা আ. এর মুক্তি ও ফেরাউনের ভরাডুবির শুকরিয়া হিসেবে। এ রোজার সঙ্গে হুসাইন রা. এর শাহাদতের কোনো সম্পর্ক নেই। এ দিবস সম্পর্কে শুদ্ধ-অশুদ্ধ অনেক হাদিস বর্ণনা করা হয়। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এর মাহাত্ম্য রোজা পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আর আশুরার ব্যাপারে এটিই মধ্যমপন্থী এবং সঠিকতম দৃষ্টিভঙ্গি। [দেখুন, লাতায়েফে মাআরেফ : ১০২-১১৩]
আশুরার ব্যাপারে দুটি শ্রেণি বিভ্রান্তিতে রয়েছে :
প্রথম দল : নাসেবিয়া, এরা আশুরা দিবসে আনন্দ-উৎসব পালন করে। আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের কিছু লোকও আছে, যারা এ ব্যাপারে ভুলের শিকার। তারা এ দিনে মেহেদি ও সুরমা লাগানো ইত্যাদি আনন্দ প্রকাশক কাজ করে। এমন করার উদ্দেশ্য- যারা এ দিনটিকে শোক দিবস হিসেবে পালন করে তাদের বিরুদ্ধাচারণ করা। কিন্তু এটাতো ভ্রান্তির বদলে ভ্রান্তিচর্চা এবং বিদআতকে প্রতিরোধ করা বিদআতের মাধ্যমে। যেমনটি বলেছেন ইবনু তাইমিয়া রহ.। [মাজমু ফাতাওয়া : ৪/৫১৩]
দ্বিতীয় দল : শিয়াদের কয়েকটি দল এ দিনকে শোক দিবস হিসেবে পালন করে। এদিন তারা গণ্ডাদেশ জখম করে, বুকের কাপড় ছিড়ে ফেলে এবং জাহিলি সব কথাবার্তা বলে। এরা এমন অবস্থায়ও উপনীত হয় যে, নিজে নিজেকে ক্ষত-বিক্ষত করে। কেউ কেউ তরবারি দিয়ে মাথায় আঘাত করে রক্ত বইয়ে দেয়। তাদের দাবি, এভাবে তারা হুসাইন রা.কে হারানোর বেদনা প্রকাশ করে। এরা নিজেদের তাঁর একান্ত ভক্ত ও অনুসারী বলেও দাবি করে। মিডিয়াগুলোও এমনভাবে প্রচার করে যেন তারাই একমাত্র আহলেবাইত বা রাসুল-পরিবারের ভক্ত। যারা তাদের মতো কাজ করে না, তারা আহলেবাইত-এর ভক্ত নয়। এটা একদম নির্জলা মিথ্যাচার।
কারণ, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতই তো আহলে বাইতকে সর্বাধিক ভালোবাসে। কিন্তু তারা ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে শরিয়ত লঙ্ঘন করে না। নিজেরা নিজেদের আহত ও বিক্ষত করার আসল কারণ- রাফেজিরা যা প্রকাশ করে না তা হলো, তারাই হুসাইন রা.কে অসম্মান করেছিল- যখন তিনি কুফার ভূমিতে তাদের কাছে এসেছিলেন। [আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ১১/৫৩০-৫৩২]
শুধু তাই নয়- তারা এর আগে হুসাইন রা. এর চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকিলকেও অপমান করেছিল। এমনকি ইবনে জিয়াদ তাঁকে হত্যা করতে সক্ষম হয়। [প্রাগুক্ত : ১১/৪৮৪-৪৮৮]
সুতরাং তাঁদের সঙ্গে অসম্মান ও বেয়াদবিপূর্ণ আচরণ করার অনুশোচনাতেই তারা মূলত এসব অসংলগ্ন আচরণ করে থাকে।
হুসাইন রা. এর শাহাদত সম্পর্কে সঠিক অবস্থান :
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত হুসাইন রা. এর শাহাদতের ঘটনাকে উম্মতের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বড় বিপদগুলোর একটি গণ্য করে। এজন্য মুসলিমগণ হৃদয়ে গভীর শোক ও অশেষ বেদনা অনুভব করেন। কিন্তু তারা শুধু এমন কাজই করেন শরিয়ত যা শিক্ষা দিয়েছে। আর শরিয়তে শোকের সময় ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিঊন’ পড়তে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও। যারা তাদেরকে যখন বিপদ আক্রান্ত করে তখন বলে, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিঊন’- নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় আমরা তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী। তাদের ওপরই রয়েছে তাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও রহমত এবং তারাই হিদায়াতপ্রাপ্ত। {সুরা বাকারা, আয়াত : ১৫৫-১৫৭}
মুসলিম শরিফে উম্মে সালামা রা. থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সা.কে বলতে শুনেছি, তিনি ইরশাদ করেন, ‘যে কোনো বান্দা কোনো বিপদের সম্মুখীন হয় অত:পর সে বলে, ‘নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় আমরা তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী, হে আল্লাহ! আমাকে আমার বিপদের বদলা দিন এবং এর চেয়ে উত্তম দান করুন’। আল্লাহ তা‘আলা অবশ্যই তার বিপদের বদলা দেবেন এবং তাকে হারানো জিনিসের চেয়ে উত্তম জিনিস দান করবেন। [মুসলিম : ৯১৮]
ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, এ ব্যাপারে উদ্ধৃত সবচেয়ে সুন্দর হাদিস বর্ণনা করেছেন ইমাম আহমদ রহ. এবং ইবনে মাজাহ রহ.। তাঁরা বলেন, ফাতেমা বিনতে হুসাইন তাঁর পিতা হুসাইন রা. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, ‘যদি কোনো মুসলিম বিপদে আক্রান্ত হয়, তারপর পরবর্তীতে সে বিপদ স্মরণ হলে ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিঊন’ পড়ে, তাহলে আল্লাহ তাআলা তার জন্য সে পরিমাণ পুণ্য লিখেন যে পরিমাণ লিখা হয়েছে বিপদে আক্রান্ত হবার দিন।’ [মুসনাদ আহমাদ : ১৭৩৪; ইবনে মাজাহ : ১৫৯৮]
তাঁরা এ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন হুসাইন তনয়া ফাতেমা থেকে। যার বাবা ওই মর্মান্তিক ঘটনায় শাহাদতবরণ করেছেন। হুসাইন রা. এর শাহাদাতের ঘটনা যে যুগে যুগে স্মরণ করা হবে তা কিন্তু অনুমান করা হয়েছিল। অথচ কী তার উদারতা যে- তিনি নিজেই নবী সা. এর পক্ষ থেকে এ সুন্নাত পৌঁছে দিয়েছেন, যাতে যখনই তাঁর এ বিপদের কথা স্মরণ করা হবে তখনই ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিঊন’ বলে মুসলমানরা সে দিনের মতো নেকি পেতে পারেন যেদিন এ বিপদ নেমে এসেছিল। [মাজমু ফাতাওয়া : ৪/৫১১-৫১২]
গালে ছুরি চালানো, বুক চাপড়ানো এবং নিজেকে ক্ষত-আহত করার যে রেওয়াজ ইদানীং চালু হয়েছে, হলফ করে বলা যায় সেটা হারাম এবং তা শরিয়ত কর্তৃক অনুমোদিত ভালোবাসার মধ্যে পড়ে না। ইবনে রজব রহ. বলেন, ‘আর হুসাইন রা. এর শাহাদাতের কারণে এ দিনটিকে শোক দিবস হিসেবে গ্রহণ করা- যেমনটি করেছে রাফেজিরা, এটা কুরআনের বাণী- ‘সে লোকদের কাজ যারা দুনিয়ার পেছনে তাদের চেষ্টা অপচয় করেছে অথচ ভাবে যে, তারা ভাল কাজ করছে’ এর অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা তো নবী-রাসুলদের মৃত্যুর দিনকেই শোকদিবস হিসেবে পালন করার নির্দেশ দেননি। তাহলে তাদের চেয়ে মর্যাদায় কম যিনি তাঁর শাহাদতের দিনকে শোকদিবস হিসেবে পালন করা হবে কিভাবে? [লাতায়েফে মাআরেফ : ১১৩]
তদুপরি খোদ হুসাইন তনয় আলী এবং তাঁর ছেলে মুহাম্মদ কিংবা তাঁর ছেলে জাফর অথবা তাঁর পুত্র মুসা (রাদিআল্লাহু তা‘আলা আনহুম) বা অন্য কোনো হেদায়াতপ্রাপ্ত ইমাম এভাবে গাল কাটা, বুক ফাড়া বা চিৎকার করার মতো অতি আবেগ কখনো প্রকাশ করেছেন বলে জানা যায় নি। এরকম করলে তাঁর পিতা আমিরুল মুমিনীন আলী রা.ই তো এর সর্বোত্তম হকদার ছিলেন। ৪০ হিজরির ১৭ রমজান পবিত্র জুমাবারে ফজর সালাত পড়তে যাওয়ার সময় তাঁকে শহীদ করা হয়। তাঁর এ শাহাদাতের দিনকে তো কেউ শোকের দিন হিসেবে পালন করে না।
গালে আঘাত করা, বুকের কাপড় ছিড়ে ফেলা কিংবা নিজে নিজেকে কষ্ট দেওয়া অবৈধ, হারাম। ইমাম বুখারি এবং মুসলিম রহ. আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘সে আমাদের উম্মতভুক্ত নয়, যে গালে আঘাত করে, বুকের কাপড় ছেড়ে এবং জাহেলি কথাবার্তা বলে। [বুখারি : ১২৯৪, মুসলিম : ১০৩]
বুখারি ও মুসলিম রহ. আবু মুসা আশআরি রা. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘আমি তাদের থেকে মুক্ত রাসুলুল্লাহ সা. যাদের থেকে মুক্ত। আর রাসুল সা. (শোকে) মাথা মুণ্ডনকারিণী, বিলাপকারিণী এবং বুক বিদীর্ণকারিণী থেকে মুক্ত। [বুখারি : ১২৩৪, মুসলিম : ১০৪]
তেমনি আবু মালেক আশআরি রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘আমার উম্মত জাহেলি যুগের চারটি স্বভাব সহজে ছাড়তে পারবে না। বংশ নিয়ে গর্ব, বংশ তুলে গালি দেওয়া, তারকা দেখে বৃষ্টি চাওয়া এবং মৃত ব্যক্তির ওপর বিলাপ করা। তিনি বলেন, বিলাপকারিণী যদি মৃত্যুর আগে তওবা না করে তাহলে কেয়ামতের দিন তাকে এমনভাবে ওঠানো হবে যে, তার সর্বাঙ্গ খোস-পাঁচড়া ও আলকাতরায় ভরা থাকবে। [মুসলিম : ৯৩৪]
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, ‘এমনিতেই এসব কাজের নিন্দায় অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে, তার সঙ্গে যদি মুসলমানের ওপর জুলুম করা, তাদের অভিশাপ দেওয়া ও গালমন্দ করা এবং তাদের মাঝে অনৈক্য ও ধর্মহীনতার বীজ বপনকারীদের সাহায্য করার মতো অপরাধ যোগ হয় তাহলে তা কত বড় গুনার কাজ বলে গণ্য হবে তা তো বলাই বাহুল্য। আল্লাহ আমাদের সঠিক পন্থা আঁকড়ে ধরার তাওফিক দান করুন।
প্রথম ঘটনা :
স্বগোত্রে মুসা আ. এর পরিত্রাণ ও স্বদলবলে ফেরাউনের পতন : ইমাম বুখারি ও মুসলিম রহ. আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. এর উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা. মদিনায় আগমন করে দেখলেন স্থানীয় ইহুদিরা আশুরা দিবসে রোজা পালন করছে। ফলে তাদেরকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলো। তারা উত্তর দিলো- এ এমন এক দিবস- যাতে আল্লাহ তা‘আলা মুসা আ.কে বিজয়ী করেছিলেন এবং বনী ইসরাঈলকে ফেরাউনের ওপর আধিপত্য দান করেছেন। এ দিনের সম্মানার্থে আমরা সিয়াম পালন করি। এতদশ্রবণে নবী সা. ইরশাদ করলেন, ‘তাহলে তো এ দিন রোজা রাখার ব্যাপারে আমরাই অধিক হকদার। অতপর রাসুলুল্লাহ সা. এ দিবসে রোজা পালনের নির্দেশ দিলেন। (বুখারি : ৩৯৪৩; মুসলিম : ১১৩০)
দ্বিতীয় ঘটনা :
নবী দৌহিত্র হযরত হুসাইন রা. এর শাহাদাত বরণ : ইরাকের কারবালা প্রান্তরে মর্মবিদারক এ ঘটনাটি ঘটেছিল ৬১ হিজরির পবিত্র জুমাবারে। [আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া : ১১/৫৬৯] এটি ছিল উম্মতের ওপর নেমে আসা সবচে বড় বিপদগুলোর একটি। আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, ‘হুসাইন রা. এর শাহাদতের ঘটনাটি মহাবিপদগুলোর একটি। কারণ, হুসাইন রা. এবং তাঁর আগে উসমান রা. এর শহীদ হওয়ার মধ্য দিয়েই পরবর্তীতে উম্মতের ওপর নেমে এসেছে অনেক মহাদুর্যোগ। আর তাঁদের শহীদ করেছে আল্লাহর নিকৃষ্ট বান্দারা। [মাজমু ফাতাওয়া ৩/৪১১]
রাসুলুল্লাহ সা. এ দিন রোজা রাখতে বলেছেন, মুসা আ. এর মুক্তি ও ফেরাউনের ভরাডুবির শুকরিয়া হিসেবে। এ রোজার সঙ্গে হুসাইন রা. এর শাহাদতের কোনো সম্পর্ক নেই। এ দিবস সম্পর্কে শুদ্ধ-অশুদ্ধ অনেক হাদিস বর্ণনা করা হয়। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এর মাহাত্ম্য রোজা পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আর আশুরার ব্যাপারে এটিই মধ্যমপন্থী এবং সঠিকতম দৃষ্টিভঙ্গি। [দেখুন, লাতায়েফে মাআরেফ : ১০২-১১৩]
আশুরার ব্যাপারে দুটি শ্রেণি বিভ্রান্তিতে রয়েছে :
প্রথম দল : নাসেবিয়া, এরা আশুরা দিবসে আনন্দ-উৎসব পালন করে। আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের কিছু লোকও আছে, যারা এ ব্যাপারে ভুলের শিকার। তারা এ দিনে মেহেদি ও সুরমা লাগানো ইত্যাদি আনন্দ প্রকাশক কাজ করে। এমন করার উদ্দেশ্য- যারা এ দিনটিকে শোক দিবস হিসেবে পালন করে তাদের বিরুদ্ধাচারণ করা। কিন্তু এটাতো ভ্রান্তির বদলে ভ্রান্তিচর্চা এবং বিদআতকে প্রতিরোধ করা বিদআতের মাধ্যমে। যেমনটি বলেছেন ইবনু তাইমিয়া রহ.। [মাজমু ফাতাওয়া : ৪/৫১৩]
দ্বিতীয় দল : শিয়াদের কয়েকটি দল এ দিনকে শোক দিবস হিসেবে পালন করে। এদিন তারা গণ্ডাদেশ জখম করে, বুকের কাপড় ছিড়ে ফেলে এবং জাহিলি সব কথাবার্তা বলে। এরা এমন অবস্থায়ও উপনীত হয় যে, নিজে নিজেকে ক্ষত-বিক্ষত করে। কেউ কেউ তরবারি দিয়ে মাথায় আঘাত করে রক্ত বইয়ে দেয়। তাদের দাবি, এভাবে তারা হুসাইন রা.কে হারানোর বেদনা প্রকাশ করে। এরা নিজেদের তাঁর একান্ত ভক্ত ও অনুসারী বলেও দাবি করে। মিডিয়াগুলোও এমনভাবে প্রচার করে যেন তারাই একমাত্র আহলেবাইত বা রাসুল-পরিবারের ভক্ত। যারা তাদের মতো কাজ করে না, তারা আহলেবাইত-এর ভক্ত নয়। এটা একদম নির্জলা মিথ্যাচার।
কারণ, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতই তো আহলে বাইতকে সর্বাধিক ভালোবাসে। কিন্তু তারা ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে শরিয়ত লঙ্ঘন করে না। নিজেরা নিজেদের আহত ও বিক্ষত করার আসল কারণ- রাফেজিরা যা প্রকাশ করে না তা হলো, তারাই হুসাইন রা.কে অসম্মান করেছিল- যখন তিনি কুফার ভূমিতে তাদের কাছে এসেছিলেন। [আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া : ১১/৫৩০-৫৩২]
শুধু তাই নয়- তারা এর আগে হুসাইন রা. এর চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকিলকেও অপমান করেছিল। এমনকি ইবনে জিয়াদ তাঁকে হত্যা করতে সক্ষম হয়। [প্রাগুক্ত : ১১/৪৮৪-৪৮৮]
সুতরাং তাঁদের সঙ্গে অসম্মান ও বেয়াদবিপূর্ণ আচরণ করার অনুশোচনাতেই তারা মূলত এসব অসংলগ্ন আচরণ করে থাকে।
হুসাইন রা. এর শাহাদত সম্পর্কে সঠিক অবস্থান :
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত হুসাইন রা. এর শাহাদতের ঘটনাকে উম্মতের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বড় বিপদগুলোর একটি গণ্য করে। এজন্য মুসলিমগণ হৃদয়ে গভীর শোক ও অশেষ বেদনা অনুভব করেন। কিন্তু তারা শুধু এমন কাজই করেন শরিয়ত যা শিক্ষা দিয়েছে। আর শরিয়তে শোকের সময় ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিঊন’ পড়তে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও। যারা তাদেরকে যখন বিপদ আক্রান্ত করে তখন বলে, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিঊন’- নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় আমরা তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী। তাদের ওপরই রয়েছে তাদের রবের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও রহমত এবং তারাই হিদায়াতপ্রাপ্ত। {সুরা বাকারা, আয়াত : ১৫৫-১৫৭}
মুসলিম শরিফে উম্মে সালামা রা. থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সা.কে বলতে শুনেছি, তিনি ইরশাদ করেন, ‘যে কোনো বান্দা কোনো বিপদের সম্মুখীন হয় অত:পর সে বলে, ‘নিশ্চয় আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয় আমরা তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী, হে আল্লাহ! আমাকে আমার বিপদের বদলা দিন এবং এর চেয়ে উত্তম দান করুন’। আল্লাহ তা‘আলা অবশ্যই তার বিপদের বদলা দেবেন এবং তাকে হারানো জিনিসের চেয়ে উত্তম জিনিস দান করবেন। [মুসলিম : ৯১৮]
ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, এ ব্যাপারে উদ্ধৃত সবচেয়ে সুন্দর হাদিস বর্ণনা করেছেন ইমাম আহমদ রহ. এবং ইবনে মাজাহ রহ.। তাঁরা বলেন, ফাতেমা বিনতে হুসাইন তাঁর পিতা হুসাইন রা. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, রাসুলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, ‘যদি কোনো মুসলিম বিপদে আক্রান্ত হয়, তারপর পরবর্তীতে সে বিপদ স্মরণ হলে ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিঊন’ পড়ে, তাহলে আল্লাহ তাআলা তার জন্য সে পরিমাণ পুণ্য লিখেন যে পরিমাণ লিখা হয়েছে বিপদে আক্রান্ত হবার দিন।’ [মুসনাদ আহমাদ : ১৭৩৪; ইবনে মাজাহ : ১৫৯৮]
তাঁরা এ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন হুসাইন তনয়া ফাতেমা থেকে। যার বাবা ওই মর্মান্তিক ঘটনায় শাহাদতবরণ করেছেন। হুসাইন রা. এর শাহাদাতের ঘটনা যে যুগে যুগে স্মরণ করা হবে তা কিন্তু অনুমান করা হয়েছিল। অথচ কী তার উদারতা যে- তিনি নিজেই নবী সা. এর পক্ষ থেকে এ সুন্নাত পৌঁছে দিয়েছেন, যাতে যখনই তাঁর এ বিপদের কথা স্মরণ করা হবে তখনই ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিঊন’ বলে মুসলমানরা সে দিনের মতো নেকি পেতে পারেন যেদিন এ বিপদ নেমে এসেছিল। [মাজমু ফাতাওয়া : ৪/৫১১-৫১২]
গালে ছুরি চালানো, বুক চাপড়ানো এবং নিজেকে ক্ষত-আহত করার যে রেওয়াজ ইদানীং চালু হয়েছে, হলফ করে বলা যায় সেটা হারাম এবং তা শরিয়ত কর্তৃক অনুমোদিত ভালোবাসার মধ্যে পড়ে না। ইবনে রজব রহ. বলেন, ‘আর হুসাইন রা. এর শাহাদাতের কারণে এ দিনটিকে শোক দিবস হিসেবে গ্রহণ করা- যেমনটি করেছে রাফেজিরা, এটা কুরআনের বাণী- ‘সে লোকদের কাজ যারা দুনিয়ার পেছনে তাদের চেষ্টা অপচয় করেছে অথচ ভাবে যে, তারা ভাল কাজ করছে’ এর অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা তো নবী-রাসুলদের মৃত্যুর দিনকেই শোকদিবস হিসেবে পালন করার নির্দেশ দেননি। তাহলে তাদের চেয়ে মর্যাদায় কম যিনি তাঁর শাহাদতের দিনকে শোকদিবস হিসেবে পালন করা হবে কিভাবে? [লাতায়েফে মাআরেফ : ১১৩]
তদুপরি খোদ হুসাইন তনয় আলী এবং তাঁর ছেলে মুহাম্মদ কিংবা তাঁর ছেলে জাফর অথবা তাঁর পুত্র মুসা (রাদিআল্লাহু তা‘আলা আনহুম) বা অন্য কোনো হেদায়াতপ্রাপ্ত ইমাম এভাবে গাল কাটা, বুক ফাড়া বা চিৎকার করার মতো অতি আবেগ কখনো প্রকাশ করেছেন বলে জানা যায় নি। এরকম করলে তাঁর পিতা আমিরুল মুমিনীন আলী রা.ই তো এর সর্বোত্তম হকদার ছিলেন। ৪০ হিজরির ১৭ রমজান পবিত্র জুমাবারে ফজর সালাত পড়তে যাওয়ার সময় তাঁকে শহীদ করা হয়। তাঁর এ শাহাদাতের দিনকে তো কেউ শোকের দিন হিসেবে পালন করে না।
গালে আঘাত করা, বুকের কাপড় ছিড়ে ফেলা কিংবা নিজে নিজেকে কষ্ট দেওয়া অবৈধ, হারাম। ইমাম বুখারি এবং মুসলিম রহ. আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ রা. থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘সে আমাদের উম্মতভুক্ত নয়, যে গালে আঘাত করে, বুকের কাপড় ছেড়ে এবং জাহেলি কথাবার্তা বলে। [বুখারি : ১২৯৪, মুসলিম : ১০৩]
বুখারি ও মুসলিম রহ. আবু মুসা আশআরি রা. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, ‘আমি তাদের থেকে মুক্ত রাসুলুল্লাহ সা. যাদের থেকে মুক্ত। আর রাসুল সা. (শোকে) মাথা মুণ্ডনকারিণী, বিলাপকারিণী এবং বুক বিদীর্ণকারিণী থেকে মুক্ত। [বুখারি : ১২৩৪, মুসলিম : ১০৪]
তেমনি আবু মালেক আশআরি রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘আমার উম্মত জাহেলি যুগের চারটি স্বভাব সহজে ছাড়তে পারবে না। বংশ নিয়ে গর্ব, বংশ তুলে গালি দেওয়া, তারকা দেখে বৃষ্টি চাওয়া এবং মৃত ব্যক্তির ওপর বিলাপ করা। তিনি বলেন, বিলাপকারিণী যদি মৃত্যুর আগে তওবা না করে তাহলে কেয়ামতের দিন তাকে এমনভাবে ওঠানো হবে যে, তার সর্বাঙ্গ খোস-পাঁচড়া ও আলকাতরায় ভরা থাকবে। [মুসলিম : ৯৩৪]
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, ‘এমনিতেই এসব কাজের নিন্দায় অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে, তার সঙ্গে যদি মুসলমানের ওপর জুলুম করা, তাদের অভিশাপ দেওয়া ও গালমন্দ করা এবং তাদের মাঝে অনৈক্য ও ধর্মহীনতার বীজ বপনকারীদের সাহায্য করার মতো অপরাধ যোগ হয় তাহলে তা কত বড় গুনার কাজ বলে গণ্য হবে তা তো বলাই বাহুল্য। আল্লাহ আমাদের সঠিক পন্থা আঁকড়ে ধরার তাওফিক দান করুন।