পাকিস্তানের জুলুমের নাগপাশ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে অনেক জীবন ও ত্যাগের বিনিময়ে। আর তখন বাংলাদেশের পাশে বন্ধু হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। বাহ্যত দৃষ্টিতে ভারত বাংলাদেশের বন্ধু। তার মানে তো এই নয় যে, প্রতিদিন পবিত্র স্বাধীন ভূমির তাজা প্রাণের বিনিময়ে ভারতের সেই বন্ধুত্বের মূল্য দিতে হবে বাংলাদেশকে? নির্ভরযোগ্য জরিপমতে, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফের হাতে দশহাজার বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছে। তাহলে এর মানে কি বাংলাদেশ পাকিস্তানের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এখন ভারতের কাছে পরাধীন? আর ভারতই কি এই সুযোগটা গ্রহণ করার জন্য আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল?
এ সংশয় আরও ঘনীভূত হলো কিশোরী ফেলানীর নির্মম হত্যাকাণ্ড এবং তার প্রহসনমূলক বিচারের মধ্য দিয়ে।
ফেলানীর বাবা কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার দক্ষিণ রামখানা ইউনিয়নের বানার ভিটা গ্রামের নুরুল ইসলাম নূরু ১০ বছর ধরে দিল্লিতে কাজ করতেন। তার সঙ্গে সেখানেই থাকতো কিশোরী ফেলানী। দেশে বিয়ে ঠিক হওয়ায় ২০১১ সালের ৭ই জানুয়ারি ভোরে বাবার সঙ্গে ফেরার পথে সীমান্ত পার হওয়ার সময় কাঁটাতারের বেড়ায় কাপড় আটকে যায় ফেলানীর। এতে ভয়ে সে চিৎকার দিলে বিএসএফ সদস্যরা তাকে গুলি করে হত্যা করে। কাঁটাতারের বেড়ায় ফেলানীর ঝুলন্ত লাশের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ সরকার ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকেও প্রতিবাদ জানানো হয়।
তখন আন্তর্জাতিক মানাবধিকার সংগঠনগুলোও বিএসএফ-এর এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করেছিল। বর্বর এই ঘটনার ওপর ২৬ জানুয়ারি অনলাইন গার্ডিয়ান-এ প্রকাশিত এক রির্পোটে বলা হয়, বাংলাদেশ সীমান্তে ভারত গুলি করে হত্যার নীতি নিয়েছে। এই সীমান্তকে দক্ষিণ এশিয়ার এক বধ্যভূমি বানানো হয়েছে। মার্কিন অন লাইন নিউজ কোম্পানি গ্লোবাল পোস্ট-এ সীমান্তে বিএসএফ-এর বাংলাদেশি হত্যা সংক্রান্ত খবরের শিরোনাম ছিলো, ‘বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া বর্ডার : ওয়াল অব ডেথ’ অর্থাৎ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত হলো মৃত্যুর সীমান্ত। ভারতের সীমান্তরক্ষী বিএসএফ-এর নৃশংসতার স্বরূপ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় কোন রূপে প্রতিভাত হচ্ছে, এই একটি উদাহরণই তা বোঝার জন্য যথেষ্ট। আজকের যুগে বিশ্বে আর কোনো সীমান্ত মৃত্যুর সীমান্ত হিসেবে গণ্য হচ্ছে- এমনটি জানা যায় না। যে কয়টি দেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত রয়েছে, বাংলাদেশ ছাড়া সেসবের কোনোটির সীমান্তেই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী এভাবে মানুষ হত্যা করছে না।
আন্তর্জাতিক প্রতিবাদের মুখে ফেলানী হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষের বিরুদ্ধে বিচারের নাটক করা হয়। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের নিজস্ব আদালতে অমিয় ঘোষের বিচারের কার্যক্রম শুরু করা হয় এবং গত ৬ সেপ্টেম্বর তাকে বেকসুর খালাস ঘোষণাও করা হয়। উল্লেখ্য, কোচবিহারের স্থানীয় থানায় প্রথম যে মামলা করা হয়েছিল, তাতে প্রাথমিক তদন্তে সত্যতা পেয়ে অমিয় ঘোষের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছিল। ভারতীয় পুলিশও তাকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেছিল। তারপরও এই রায় শুধু চরম হতাশাজনকই নয়, বরং এতে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আন্তরিকতা প্রমাণে আবারও ভারতের ব্যর্থতাই স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে।
বিচার নিয়ে এই তামাশা ও নাটকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিশিষ্টজনেরা, মানবাধিকার সংগঠনগুলো এমনকি ভারতের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনও প্রতিবাদ জানায়। ভারতের মানবাধিকার সংগঠনগুলো ফেলানী হত্যাকাণ্ডের প্রহসনমূলক এ রায়কে ভারতীয় সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থী বলে অভিহিত করেছে। কলকাতার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম) এর সেক্রেটারি কিরিট রায় বলেছেন, বিএসএফ সীমান্তে কেবল ত্রাসের রাজত্বই কয়েম করেনি; বিচারের নামে নাটকও সাজিয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, ‘রায়ের মাধ্যমে আমরা দেখলাম একদমই ন্যায়বিচারের সঙ্গে তামাশা করা হয়েছে। একটা প্রহসনমূলক বিচার হয়েছে। এতে করে শুধু ফেলানীর আত্মা এবং তার পরিবারের সঙ্গেই নয়, পুরো বাঙালি জাতির সঙ্গেই একটা প্রহসন করা হয়েছে। এই বিচারের মাধ্যমে তারা আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি দারুণভাবে অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছে।’
ড. মিজানুর রহমানকে ধন্যবাদ (!) জানাই, তিনি শাপলা চত্বর, সাভার ট্রাজেডিসহ আরও অনেক বিষয়ে নীরব রয়েছেন ঠিক, তবে মৃদু হলেও ফেলানী বিষয়ে মুখ খুলেছেন। অবশ্য দেশের মানুষ সরকারের পক্ষ থেকে যেরূপ জোরালো পদক্ষেপের প্রত্যাশা করেছিল, তার সিকিভাগও বাংলাদেশ সরকার করেনি। সরকারের মন্ত্রী আমলারা গা বাঁচানো বিবৃতি দিয়েছে; শক্ত কোনো প্রতিবাদী ভাষা ব্যবহার করেনি। তাদের এই নমনীয় নীতিতে হতাশ এ দেশের মানুষ। কেন সরকারের এই হীনমন্যতা ও নতজানু নীতি, তা বোধগম্য নয়। ভারত আমাদের রক্তের ওপর দিয়ে প্রতিনিয়ত হলি খেলে চলেছে আর আমাদের সরকার উল্টো ভারতের এসব অন্যায় আচরণ মুখ বুজে সহ্য করছে। দাদা-দিদির অসন্তুষ্টির এতো ভয় কেন আমাদের? আমাদের রক্ত কি এতোই সস্তা যে, এভাবেই তা ভারতের নখরাঘাতে প্রতিনিয়ত ঝরতে থাকবে?
শুনেছি ভারত পুনর্বিচারের আশ্বাস দিয়েছে বাংলাদেশকে। কিন্তু এটাও যে আগের মতোই পরিস্থিতিকে শান্ত করার জন্য বাংলাদেশকে ‘বিচারের মুলা’ দেখানো নয়, তা আমরা বিশ্বাস করতে পারছি না।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষের যদি ন্যায়বিচারে আগ্রহ থাকতো, তাহলে ফেলানী হত্যার বিচার করা উচিত ছিলো ভারতের ফৌজদারি আদালতে, বিএসএফের নিজস্ব আদালতে নয়। কারণ, হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি বিএসএফের সদস্য, জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্সেস কোর্ট নামে বিএসএফের নিজস্ব আদালতে তাঁর বিচার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ না হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের কর্মকর্তা এ আশঙ্কা আগেই ব্যক্ত করেছিলেন।
সীমান্তে বিএসএফের সদস্যদের হাতে বাংলাদেশি নাগরিকদের নির্বিচার হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ভারতের প্রতি বাংলাদেশের জনসাধারণের বিরূপ মনোভাব দুই দেশের সম্পর্কের বড় নাজুক দিক। বাংলাদেশের মানুষের স্বজন হারানোর বেদনা ও ক্ষোভের প্রতি ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এমন অসংবেদনশীলতার প্রকাশ ঘটাতে থাকলে দুই দেশের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতেও ফেলানী হত্যার ন্যায়বিচার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
বর্তমানে পৃথিবীর একমাত্র রক্তাক্ত সীমান্তে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত। বাংলাদেশী হত্যার পরই আলোচনার নামে ভারত বরাবরই প্রহসনমূলক আচরণ করে আসছে। বিশ্ববিবেককে ধোকা দিয়ে আসছে। প্রতিনিয়ত বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা, গুম ও নির্যাতন করেই চলছে এ বাহিনী। এসব ঘটনা তারা ঘটিয়েছে কখনও গুলি চালিয়ে, বোমা ফাটিয়ে আবার কখনও পাথর নিক্ষেপ করে। বিজিবি ও বিএসএফের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে সীমান্ত হত্যাকাণ্ড বন্ধের ঘোষণা হলেও বিএসএফ তা মানছে না।
ভারত থেকে সীমান্ত দিয়ে অবৈধ পথে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে মাদকদ্রব্য ঢুকছে বাংলাদেশে। কই? আমরা কখনো তো শুনিনি, মাদক পাচারকালে কেউ ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছে? বরং গরু পাচার, অথবা ফেলানীর মতো নিরীহ কোনো বাঙালীর সীমান্ত পারাপারের সময়েই বিএসএফের হাতে প্রাণ দিতে হচ্ছে। ভারতের কাছে মাদকদ্রব্য নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করা কোনো অপরাধ নয়, বরং অপরাধ হলো জীবিকার তাগিদে কিংবা প্রাণের টানে ছুটে আসা। তাদের দেশের তৈরি মাদকের নীল ছোবলে বাংলাদেশের মানবশক্তি নিস্ক্রিয় হয়ে পড়–ক, এটাই তাদের কামনা বৈকি?
ধারাবাহিক সীমান্তহত্যা এবং সর্বশেষ ফেলানী হত্যা ও এর প্রহসনমূলক বিচার যেন এটাই প্রমাণ করছে, সীমান্তের কাঁটাতারে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৃত্যু হয়েছে।
প্রতিবেশী দুটি দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক থাকবে, যাতে দু’ দেশেরই উন্নতি ও সমৃদ্ধি বাড়ে, এটাই স্বাভাবিক। ভৌগলিক বিচারেও বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সুসম্পর্ক অপরিহার্য। কিন্তু ভারত প্রতিনিয়তই বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণকে দূর্বলতা মনে করে এদেশের লাল-সবুজের পতাকাকে ক্ষত-বিক্ষত করে চলেছে। টিপাইমুখ, ফারাক্কাবাঁধ ও বাংলাদেশ-ভারতসীমান্তবর্তী বিভিন্ন নদীপ্রকল্প নিয়ে ছলচাতুরিতার আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশকে একটি রুক্ষ-মরুভূমির দেশ বানানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তাই পুরনো কথাটাই নতুন করে বলতে হচ্ছে যে, আমরা পিণ্ডির শৃঙ্খল থেকে মুক্তিলাভ করেছি; দিল্লির দাসত্ব করার জন্য নয়। বাংলাদেশ সরকারকে এদেশের স্বাধীনপ্রিয় কোটি মানুষের হৃদয়ের কথা অনুধাবন করতে হবে। শুধুমাত্র দাদা-দিদির খুশির কথা ভাবলে চলবে না। আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুসরণ করে সীমান্তহত্যা বন্ধসহ দু’দেশের অমীমাংসিত বিষয়গুলো মীমাংসার ব্যাপারে কঠোর কুটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে হবে। তা না হলে ভারতের আচরণবিধি ক্রমেই সীমালংঘন করতে থাকবে।
এ সংশয় আরও ঘনীভূত হলো কিশোরী ফেলানীর নির্মম হত্যাকাণ্ড এবং তার প্রহসনমূলক বিচারের মধ্য দিয়ে।
ফেলানীর বাবা কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার দক্ষিণ রামখানা ইউনিয়নের বানার ভিটা গ্রামের নুরুল ইসলাম নূরু ১০ বছর ধরে দিল্লিতে কাজ করতেন। তার সঙ্গে সেখানেই থাকতো কিশোরী ফেলানী। দেশে বিয়ে ঠিক হওয়ায় ২০১১ সালের ৭ই জানুয়ারি ভোরে বাবার সঙ্গে ফেরার পথে সীমান্ত পার হওয়ার সময় কাঁটাতারের বেড়ায় কাপড় আটকে যায় ফেলানীর। এতে ভয়ে সে চিৎকার দিলে বিএসএফ সদস্যরা তাকে গুলি করে হত্যা করে। কাঁটাতারের বেড়ায় ফেলানীর ঝুলন্ত লাশের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ সরকার ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকেও প্রতিবাদ জানানো হয়।
তখন আন্তর্জাতিক মানাবধিকার সংগঠনগুলোও বিএসএফ-এর এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করেছিল। বর্বর এই ঘটনার ওপর ২৬ জানুয়ারি অনলাইন গার্ডিয়ান-এ প্রকাশিত এক রির্পোটে বলা হয়, বাংলাদেশ সীমান্তে ভারত গুলি করে হত্যার নীতি নিয়েছে। এই সীমান্তকে দক্ষিণ এশিয়ার এক বধ্যভূমি বানানো হয়েছে। মার্কিন অন লাইন নিউজ কোম্পানি গ্লোবাল পোস্ট-এ সীমান্তে বিএসএফ-এর বাংলাদেশি হত্যা সংক্রান্ত খবরের শিরোনাম ছিলো, ‘বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া বর্ডার : ওয়াল অব ডেথ’ অর্থাৎ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত হলো মৃত্যুর সীমান্ত। ভারতের সীমান্তরক্ষী বিএসএফ-এর নৃশংসতার স্বরূপ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় কোন রূপে প্রতিভাত হচ্ছে, এই একটি উদাহরণই তা বোঝার জন্য যথেষ্ট। আজকের যুগে বিশ্বে আর কোনো সীমান্ত মৃত্যুর সীমান্ত হিসেবে গণ্য হচ্ছে- এমনটি জানা যায় না। যে কয়টি দেশের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত রয়েছে, বাংলাদেশ ছাড়া সেসবের কোনোটির সীমান্তেই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী এভাবে মানুষ হত্যা করছে না।
আন্তর্জাতিক প্রতিবাদের মুখে ফেলানী হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষের বিরুদ্ধে বিচারের নাটক করা হয়। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের নিজস্ব আদালতে অমিয় ঘোষের বিচারের কার্যক্রম শুরু করা হয় এবং গত ৬ সেপ্টেম্বর তাকে বেকসুর খালাস ঘোষণাও করা হয়। উল্লেখ্য, কোচবিহারের স্থানীয় থানায় প্রথম যে মামলা করা হয়েছিল, তাতে প্রাথমিক তদন্তে সত্যতা পেয়ে অমিয় ঘোষের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছিল। ভারতীয় পুলিশও তাকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেছিল। তারপরও এই রায় শুধু চরম হতাশাজনকই নয়, বরং এতে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে আন্তরিকতা প্রমাণে আবারও ভারতের ব্যর্থতাই স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে।
বিচার নিয়ে এই তামাশা ও নাটকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিশিষ্টজনেরা, মানবাধিকার সংগঠনগুলো এমনকি ভারতের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনও প্রতিবাদ জানায়। ভারতের মানবাধিকার সংগঠনগুলো ফেলানী হত্যাকাণ্ডের প্রহসনমূলক এ রায়কে ভারতীয় সংবিধানের মূলনীতির পরিপন্থী বলে অভিহিত করেছে। কলকাতার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম) এর সেক্রেটারি কিরিট রায় বলেছেন, বিএসএফ সীমান্তে কেবল ত্রাসের রাজত্বই কয়েম করেনি; বিচারের নামে নাটকও সাজিয়েছে। বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, ‘রায়ের মাধ্যমে আমরা দেখলাম একদমই ন্যায়বিচারের সঙ্গে তামাশা করা হয়েছে। একটা প্রহসনমূলক বিচার হয়েছে। এতে করে শুধু ফেলানীর আত্মা এবং তার পরিবারের সঙ্গেই নয়, পুরো বাঙালি জাতির সঙ্গেই একটা প্রহসন করা হয়েছে। এই বিচারের মাধ্যমে তারা আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি দারুণভাবে অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছে।’
ড. মিজানুর রহমানকে ধন্যবাদ (!) জানাই, তিনি শাপলা চত্বর, সাভার ট্রাজেডিসহ আরও অনেক বিষয়ে নীরব রয়েছেন ঠিক, তবে মৃদু হলেও ফেলানী বিষয়ে মুখ খুলেছেন। অবশ্য দেশের মানুষ সরকারের পক্ষ থেকে যেরূপ জোরালো পদক্ষেপের প্রত্যাশা করেছিল, তার সিকিভাগও বাংলাদেশ সরকার করেনি। সরকারের মন্ত্রী আমলারা গা বাঁচানো বিবৃতি দিয়েছে; শক্ত কোনো প্রতিবাদী ভাষা ব্যবহার করেনি। তাদের এই নমনীয় নীতিতে হতাশ এ দেশের মানুষ। কেন সরকারের এই হীনমন্যতা ও নতজানু নীতি, তা বোধগম্য নয়। ভারত আমাদের রক্তের ওপর দিয়ে প্রতিনিয়ত হলি খেলে চলেছে আর আমাদের সরকার উল্টো ভারতের এসব অন্যায় আচরণ মুখ বুজে সহ্য করছে। দাদা-দিদির অসন্তুষ্টির এতো ভয় কেন আমাদের? আমাদের রক্ত কি এতোই সস্তা যে, এভাবেই তা ভারতের নখরাঘাতে প্রতিনিয়ত ঝরতে থাকবে?
শুনেছি ভারত পুনর্বিচারের আশ্বাস দিয়েছে বাংলাদেশকে। কিন্তু এটাও যে আগের মতোই পরিস্থিতিকে শান্ত করার জন্য বাংলাদেশকে ‘বিচারের মুলা’ দেখানো নয়, তা আমরা বিশ্বাস করতে পারছি না।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষের যদি ন্যায়বিচারে আগ্রহ থাকতো, তাহলে ফেলানী হত্যার বিচার করা উচিত ছিলো ভারতের ফৌজদারি আদালতে, বিএসএফের নিজস্ব আদালতে নয়। কারণ, হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি বিএসএফের সদস্য, জেনারেল সিকিউরিটি ফোর্সেস কোর্ট নামে বিএসএফের নিজস্ব আদালতে তাঁর বিচার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ না হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের কর্মকর্তা এ আশঙ্কা আগেই ব্যক্ত করেছিলেন।
সীমান্তে বিএসএফের সদস্যদের হাতে বাংলাদেশি নাগরিকদের নির্বিচার হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ভারতের প্রতি বাংলাদেশের জনসাধারণের বিরূপ মনোভাব দুই দেশের সম্পর্কের বড় নাজুক দিক। বাংলাদেশের মানুষের স্বজন হারানোর বেদনা ও ক্ষোভের প্রতি ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এমন অসংবেদনশীলতার প্রকাশ ঘটাতে থাকলে দুই দেশের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতেও ফেলানী হত্যার ন্যায়বিচার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
বর্তমানে পৃথিবীর একমাত্র রক্তাক্ত সীমান্তে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত। বাংলাদেশী হত্যার পরই আলোচনার নামে ভারত বরাবরই প্রহসনমূলক আচরণ করে আসছে। বিশ্ববিবেককে ধোকা দিয়ে আসছে। প্রতিনিয়ত বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা, গুম ও নির্যাতন করেই চলছে এ বাহিনী। এসব ঘটনা তারা ঘটিয়েছে কখনও গুলি চালিয়ে, বোমা ফাটিয়ে আবার কখনও পাথর নিক্ষেপ করে। বিজিবি ও বিএসএফের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে সীমান্ত হত্যাকাণ্ড বন্ধের ঘোষণা হলেও বিএসএফ তা মানছে না।
ভারত থেকে সীমান্ত দিয়ে অবৈধ পথে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে মাদকদ্রব্য ঢুকছে বাংলাদেশে। কই? আমরা কখনো তো শুনিনি, মাদক পাচারকালে কেউ ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছে? বরং গরু পাচার, অথবা ফেলানীর মতো নিরীহ কোনো বাঙালীর সীমান্ত পারাপারের সময়েই বিএসএফের হাতে প্রাণ দিতে হচ্ছে। ভারতের কাছে মাদকদ্রব্য নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করা কোনো অপরাধ নয়, বরং অপরাধ হলো জীবিকার তাগিদে কিংবা প্রাণের টানে ছুটে আসা। তাদের দেশের তৈরি মাদকের নীল ছোবলে বাংলাদেশের মানবশক্তি নিস্ক্রিয় হয়ে পড়–ক, এটাই তাদের কামনা বৈকি?
ধারাবাহিক সীমান্তহত্যা এবং সর্বশেষ ফেলানী হত্যা ও এর প্রহসনমূলক বিচার যেন এটাই প্রমাণ করছে, সীমান্তের কাঁটাতারে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৃত্যু হয়েছে।
প্রতিবেশী দুটি দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক থাকবে, যাতে দু’ দেশেরই উন্নতি ও সমৃদ্ধি বাড়ে, এটাই স্বাভাবিক। ভৌগলিক বিচারেও বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সুসম্পর্ক অপরিহার্য। কিন্তু ভারত প্রতিনিয়তই বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণকে দূর্বলতা মনে করে এদেশের লাল-সবুজের পতাকাকে ক্ষত-বিক্ষত করে চলেছে। টিপাইমুখ, ফারাক্কাবাঁধ ও বাংলাদেশ-ভারতসীমান্তবর্তী বিভিন্ন নদীপ্রকল্প নিয়ে ছলচাতুরিতার আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশকে একটি রুক্ষ-মরুভূমির দেশ বানানোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তাই পুরনো কথাটাই নতুন করে বলতে হচ্ছে যে, আমরা পিণ্ডির শৃঙ্খল থেকে মুক্তিলাভ করেছি; দিল্লির দাসত্ব করার জন্য নয়। বাংলাদেশ সরকারকে এদেশের স্বাধীনপ্রিয় কোটি মানুষের হৃদয়ের কথা অনুধাবন করতে হবে। শুধুমাত্র দাদা-দিদির খুশির কথা ভাবলে চলবে না। আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুসরণ করে সীমান্তহত্যা বন্ধসহ দু’দেশের অমীমাংসিত বিষয়গুলো মীমাংসার ব্যাপারে কঠোর কুটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে হবে। তা না হলে ভারতের আচরণবিধি ক্রমেই সীমালংঘন করতে থাকবে।