সুন্দরবন বাচাও
শামছ আরেফিন
পৃথিবীর সপ্তম প্রাকৃতিক আশ্চর্য সুন্দরবন। যার জীববৈচিত্র্য-গাছগাছালি, পশুপাখি, আবহাওয়া পরিবেশ একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। এখানে গাছগাছালি ছাড়া যেমন জীববৈচিত্র্যের অস্তিত্ব থাকবে না, ঠিক তেমনি নোনাপানির একটু আধিক্য হলেই বিপর্যস্ত হবে এর সকল বৈচিত্র্য। আর তাই সুন্দরবনের মিঠা পানির উৎস ব্যহত হওয়া, অতিরিক্ত তাপমাত্রায় গাছশূন্য হওয়া স্বাভাবিক। কেননা সাগরের জোয়ারের সময় এই বনের নিম্নাংশ পানিতে তলিতে যায়। আবার ভাটার সময় পশুর নদীর পানি পেয়ে এই গাছগুলো ও জীববৈচিত্র্য জীবন ধারণ করার সুযোগ পায়। অর্থাৎ মিঠা ও নোনাপানির অপূর্ব এক সমন্বয়ে বেঁচে থাকে সুন্দরবন, বেঁচে থাকে এর পশু পাখি। শীত ও গ্রীষ্মে বৃষ্টিপাত কমে যাওয়ার কারণে পশুর নদীর পানি অনেকটাই কমে যায়। এ সময়ে সুন্দরবনের জলাধারের অভ্যন্তরে লবণাক্ততা বেড়ে যায়। তবু কিছু মিঠাপানির জলাধার ও একমাত্র পশুর নদীর মিঠা পানিতে কোনমতে বেঁচে যায় পুরো প্রকৃতি। আবার বর্ষা ও শরতের প্রচুর বৃষ্টিপাতের সময় বনের প্রাণীরা প্রাণ ফিরে পায়। বনের সর্বত্র পাওয়া যায় মিঠা পানি। বৃষ্টির পানিতে সুন্দরী ও গড়ানগাছের গোটা ভেসে ভেসে নতুন জেগে ওঠা মাটির ডিবিতে এসে জড়ো হয়। এখান থেকে শুরু হয় নতুন করে আবার সুন্দরী ও গড়ানগাছে ঘেরা নবজাতক সুন্দরবনের অংশ। এভাবে শীত-গ্রীষ্মে শুকিয়ে অতিরিক্ত লবণাক্ততায় সুন্দরী ও গড়ান শুকিয়ে মরে বনের যে ক্ষতি হয়, তা আবার বর্ষায় নতুন সুন্দরী ও গড়ানের জন্মে পূরণ হয়। প্রকৃতির নিয়মকে ব্যহত করা গেলেই সহজেই ধ্বংস করা যাবে সুন্দরবন। তা যেমন জানে চাণক্যের দেশের কুটিল রাজনীতিবিদ, তেমনি জানে এদেশের বিশেষজ্ঞরা। আর তাই রামপাল বিদ্যুতকেন্দ্র তৈরির মহাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আর আমরাও যুদ্ধাপোরাধী বিচারের নামে রাস্তায় নামছি, সর্বস্ব দিয়ে নিজেদের প্রতিবাদ জানাচ্ছি, ঠিক এ সুযোগে বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের সব পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়েছে।
২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রীর সফরে মূলত দ’ুদেশের যৌথভাবে বিদ্যুতকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। এ লক্ষ্যে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য ভারতের ‘ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার কর্পোরেশন’ এর সাথে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ বোর্ডের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যাতে সুন্দরবন থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে রামপালে একটি কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুতকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু
‘ঊহারৎড়হসবহঃধষ ওসঢ়ধপঃ অংংবংংসবহঃ’ ছাড়া এই প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর তড়িঘড়ি করে ‘ঊহারৎড়হসবহঃধষ ওসঢ়ধপঃ অংংবংংসবহঃ’ রিপোর্ট করে এই প্রকল্পের বৈধতা দান করা হয়। অথচ ভারতের রাজ্য ছত্তিশগড়ে একই প্রস্তাব এই ঘঞঈচ কোম্পানী দিয়েছিল। কিন্তু রাজ্যের পরিবেশগত ছাড়পত্র না পাওয়ায় তা বাতিল হয়ে যায়। সুন্দরবনের চারপাশ ১০ কিলোমিটার পরিবেশ মন্ত্রণালয় ঘোষিত ‘ঊপড়ষড়মরপধষষু ঈৎরঃরপধষ ধৎবধ’ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। ঊহারৎড়হসবহঃধষ ওসঢ়ধপঃ অংংবংংসবহঃ রিপোর্টে বলা হয়, প্রস্তাবিত বিদ্যুতকেন্দ্রের অবস্থান ১৪ কিলোমিটার দূরে। অথচ জিআইসি সফ্টওয়ার দিয়ে মেপে সহজেই প্রমাণ করা যায়- তা সর্বোচ্চ ৯-১৩ কিলোমিটার দূরে। অথচ ভারতেরই ‘ওয়াইল্ড লাইফ প্রাটেকশন অ্যাক্ট ১৯৭২’ এ বলা হয়, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১৫ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে কোনো বাঘ বা হাতি সংরক্ষণ অঞ্চল, জীববৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বনাঞ্চল, জাতীয় উদ্যান, বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য কিংবা অন্য কোনো সংরক্ষিত বনাঞ্চল থাকা চলবে না। রামপাল থেকে অন্যস্থানে প্রতিস্থাপন না করার কারণ হিসেবে আরও উল্লেখ করা হয়Ñ মূলত ভূমিকম্পমুক্ত অঞ্চলে এই ব্যয়বহুল নির্মাণ করাটাই সংযত। কিন্তু খুলনার আশেপাশে এমন অনেক অঞ্চল রয়েছে, যাতে তেমন ভূকম্পনের সম্ভাবনা নেই। আর তাই মানচিত্রে ভূমিকম্পের রেখা দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
জমি অধিগ্রহণেও স্বেচ্চাচারিতা লক্ষ করার মতো। ভারতেই একই প্রকল্প বাস্তবায়ন করার জন্য ৭৯২ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশের একই পরিমাণ ১৩২০ মেগাওয়েট বিদ্যুত উৎপাদনের জন্য ১৮৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ করার কথা বলা হয়। যার ৯৫ শতাংশই তিন ফসলি কৃষি জমি। যেখানে বছরে ১২৮৫ টন ধান ও ৫৬৯ দশমিক ৪১ মেট্রিক টন মাছ উৎপাদিত হয়। এই ধান-মাছ উৎপাদন বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে এখন প্রায় ৮ হাজার পরিবার উচ্ছেদ হবে, যার মধ্যে উদ্বাস্তু এবং কর্মহীন হয়ে যাবে প্রায় ৭ হাজার ৫০০ পরিবার।
ইআইএর প্রতিবেদন অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রে বাষ্প দিয়ে টারবাইন ঘোরানো ও শীতলীকরণসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের জন্য পশুর নদী থেকে ঘণ্টায় ৯১৫০ ঘনমিটার করে পানি প্রত্যাহার করা হবে এবং ব্যবহারের পর অবশিষ্ট পানি পরিশোধন করে ঘণ্টায় ৫১৫০ ঘনমিটার হারে আবার নদীতে ফেরত দেওয়া হবে। ফলে নদী থেকে প্রতি ঘণ্টায় কার্যকর পানি প্রত্যাহারের পরিমাণ হবে ৪০০০ ঘনমিটার। এই পানি প্রত্যাহারের কারণে নদীর নিম্নপ্রবাহে সুন্দরবন এলাকায় পানির লবণাক্ততা, নদীর পলি প্রবাহ, প্লাবন, জোয়ার-ভাটা, মাছসহ নদীর উদ্ভিদ ও প্রাণীজগৎ ও বাস্তুব্যবস্থার ওপর কেমন প্রভাব পড়বে তার কোনো বিশ্লেষণ করা হয়নি। এর পেছনে তাদের যুক্তি হচ্ছে, ৪০০০ ঘনমিটার পানি পশুর নদীর শুকনো মওসুমের মাটি পানি প্রবাহের ১ শতাংশেরও কম। এখানে ২০০৫ সালের পানি প্রবাহের তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে।
সুতরাং, এতে যেমন পশুর নদীর পানি প্রবাহ হ্রাস পাবে, তেমনি সুন্দরবনের অভ্যন্তরে নদীর প্রবাহও হ্রাস পাবে। লবণাক্ততা বেড়ে যাবে সুন্দরবনে। মিঠাপানির উৎস হ্রাস পাবে। খাবার বা আশ্রয়ের খোঁজে বন্যপ্রাণী পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনেই ধাবিত হবে। আর তাই ভারত পুরো বাংলাদেশ ঘিরে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করলেও, সুন্দরবন অঞ্চলে কোনো বেড়া নির্মাণ করেনি। এ এক অতি আধুনিক পন্থা জীববৈচিত্র্য ও প্রাণীসম্পদ দখল করার। গ্রীষ্মে যেমন বাংলাদেশকে শুকিয়ে মারা যায়, তেমনি বর্ষায় মারা যায় পানিতে ডুবিয়ে। আবার তার সৌন্দর্য হরণ করা যায় সহায়তার নাম দিয়ে। এরচেয়ে চাণক্যের সূত্রের প্রায়োগিক দিক আর কী হতে পারে! ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্ক সেই একই সূত্রে গাঁথা। আমরা সেই সীমাকে অতিক্রম করতে পারি না। কারণ ভারত আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র তারা যেমনটি বলে থাকে। অথচ আমাদের বেশিরভাগ স্বাধীন নাগরিক বিএসএফই হত্যা করে। আমরা তাদের বন্ধু কিন্তু কোনোদিনও পানির ন্যায্য হিস্যা আমরা পাইনি, পাবও না । নিকটতম প্রতিবেশীদের সাথে মূলত ভারতের কোনো বন্ধুত্বের সম্পর্ক হতে পারে না রাজনীতিতে। কারণ নীকটবর্তী রাষ্ট্রের পাশ্ববর্তী রাষ্ট্রই ভারতের বন্ধু। আর শত্র“র শত্র“ তাদের মিত্র হতে পারে। এটাই চাণক্যের সূত্র। আর এ কারণে দেখা যায় প্রতিবেশী চিনের বিপরীতে রাশিয়ার সাথে ভারতের সর্ম্পক। ঠিক তেমনি পাকিস্তানের বদল আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের বদল মায়ানমার। আর তাই শত্র“র শত্র“ বাংলাদেশের সাথে বৈরি মায়ানমারকে সাহায্য করতে সমুদ্র মামলায় জেতাতে ভারতের আইনজীবীর আর্ন্তজাতিক আদালতে লড়াই করতে দেখা যায়। আর এইভাবে আমরা দেখি আমাদের দেশে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক উপনিবেশ স্থাপনের জন্য কীভাবে জাতীয় রাজনীতিকে প্রভাবিত করা হচ্ছে। এবারের ২০১৩ জুলাই বাজেটে দেখা যায়, সরকার আমদানিকৃত মটরসাইকেলে শুল্ক হ্রাস করেছে। যাতে দেশি মটরসাইকেল শিল্প ধ্বংস করে দেওয়া যায়। শুধু তাই নয়; রিকন্ডিশন গাড়ির ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ করে বাংলাদেশে ভারতের গাড়ির বাজার সৃষ্টি করে দেওয়া হয়েছে। সেই সাথে এ দেশের কৃষি উৎপাদনকে ব্যহত করার জন্য একের পর এক বাঁধ দিয়ে উজান থেকে পানি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ এখন ভারতের পণ্যের ওপর নির্ভরশীল একটি দেশ। এ দেশের সোনালি আঁশ পাট আর নেই। বরং পাটের নতুন ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়েছে এখন কলকাতায়। সুতরাং অর্থনৈতিক আগ্রাসন সুনিশ্চিত হবার পর এখন রাজনৈতিক আগ্রাসন চালানোর পথ সুগম করা হয়েছে সেই একই নীতি অনুসরণ করে। যেমন চাণক্য বলেছেন, ‘যদি তুমি পার্শ্ববর্তী দুর্বল দেশকে দখল করতে চাও, তবে সেই দেশের দুর্বলদের সমর্থন দাও। দুর্বলরা ক্ষমতায় আসতে তোমার সহয়াতার প্রয়োজন হবে। তাদের তুমি ক্ষমতায় আসতে সহায়তা করবে। ক্ষমতা দখলের পর তাদের নিজস্বার্থে কাজে লাগবে। কারণ দুর্বল ব্যক্তিকে যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় ঠিক সেইভাবে দুর্বল দেশকেও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তাই তিনি বলেন, ‘যে লোক দুর্বল, সে সাধারণত ভীরু হয়। কিছুটা সুবিধাবাদী, লোভী স্বার্থপর ও অনৈতিক তো হবেই। আর তাই তার আচরণও প্রচণ্ড গুপ্তচরভীতি তৈরি করে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। মাঝে মাঝে যৎসামান্য উপহার তাকে দেওয়া হবে তার আনুগত্যের নিদর্শন সরূপ।’ এই সবগুলোই এ দেশের শাসকদের চরিত্রের সাথে মিলে যায়। আর তাই তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে সেই পন্থাগুলোও ব্যবহৃত হয়। যার ভুক্তভোগী হতে হয় দেশ ও সাধারণ জনতাকে। নতজানু পররাষ্ট্রনীতি, তিস্তার ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার আগেই ট্রানজিট দেওয়া, নির্বিচারে সীমান্তে গণহত্যা, বিএসএফেল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বৈধতা প্রদান, বাংলাদেশের তালপট্টি দ্বীপ দখলসহ সীমান্তে বিভিন্ন গ্রাম দখল ও ছিটমহলে ভারতীয় শাসন ব্যবস্থা মানতে বাধ্য করা হয়। তারপরও তারা আমাদের বন্ধু, তারাই আমাদের ত্রাণকর্তা। স্টার জলসা, ভারতীয় চলচ্চিত্র ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ছোবলে দেশীয় সংস্কৃতি বিকিয়ে দিয়ে জীবন ধারণ করতে হবে বাংলাদেশ নামক পরগাছাকে। প্রতিবেশীর আগ্রাসী ছোবলে নির্বাক থাকবে স্বদেশ প্রেম স্বাধীনতা ও মূল্যবোধ।#